হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভক্তি প্রকট: এপি'র বিশ্লেষণ


ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের এক বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশে রাজনৈতিক ঐক্যের চেয়ে বিভক্তির চিত্রই স্পষ্টতর হচ্ছে। এ বিভক্তির পেছনে রয়েছে নানা কারণ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ধর্মীয় মেরুকরণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক টানাপড়েন।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গণ-আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর অনেকেই ধারণা করেছিলেন, বাংলাদেশ একটি নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। সহিংস ওই অভ্যুত্থানে শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটে। পরবর্তীতে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, সাংবিধানিক সংস্কার এবং শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দেন।
কিন্তু এক বছর পর দেখা যাচ্ছে, সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। রাজনৈতিক বিভাজন, প্রশাসনিক অস্থিরতা, এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি ক্রমশ পরিস্থিতিকে কঠিন করে তুলছে।
শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী ছাত্রদের একটি অংশ। তারা গঠন করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), যা দেশের দুই প্রধান দল—আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আধিপত্য ভাঙার কথা বলছে।
তবে বিরোধীরা অভিযোগ করছে, এই নতুন দলটি ইউনূস সরকারের ঘনিষ্ঠ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে।
অন্যদিকে, দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকা ইসলামপন্থি দল জামায়াতে ইসলামী নতুন করে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী এই দলটির বর্তমান মাঠপর্যায়ের শক্তি এখনো অজানা হলেও এর পুনরাবির্ভাব রাজনীতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
মে মাসে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম 'বিচারাধীন থাকা পর্যন্ত' নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। শেখ হাসিনা বর্তমানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারের মুখোমুখি। এই শূন্যতা পূরণে রাজনীতির বিভিন্ন পক্ষই মরিয়া হয়ে উঠেছে।
একসময়কার জোটসঙ্গী বিএনপি ও জামায়াত বর্তমানে প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তার নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত। একই সঙ্গে, নতুন নির্বাচন কবে হবে—এ নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতপার্থক্য রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের কথা বললেও, অন্তর্বর্তী সরকার সে অবস্থানে অনীহা প্রকাশ করেছে।
নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যমত্যের অভাব আরও জটিলতা সৃষ্টি করেছে। সময়সীমা নির্ধারণ, দ্বি-স্তরের সংসদ ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা—এই ধরনের প্রস্তাব নিয়ে চলছে বিতর্ক।
এনসিপি এবং জামায়াতে ইসলামীর অনেক মতামত মিল থাকলেও, বিএনপি ডিসেম্বর বা ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছে। বিপরীতে, জামায়াত সংস্কার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন পেছানোর পক্ষে। ফলে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে মেরুকরণ আরও তীব্র হয়েছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান মন্তব্য করেন, “সংস্কারের বিষয়টি দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারত, কিন্তু তা আরও বিভক্ত করেছে। এখন স্পষ্ট—একদল সময় চায় সংস্কারের জন্য, আরেকদল দ্রুত নির্বাচন চায়।”
অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে মানবাধিকার পরিস্থিতিও এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অভিযোগ—প্রশাসন তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের তথ্যমতে, গত এক বছরে শতাধিক হামলার শিকার হয়েছেন সংখ্যালঘুরা।
অপরদিকে, আওয়ামী লীগ অভিযোগ করেছে—হাজার হাজার দলীয় কর্মী-সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের উপ-পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি জানান, হাসিনার আমলে সংঘটিত গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা বন্ধ হলেও, নিরাপত্তা খাতে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গঠনের ক্ষেত্রে সরকারের অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়।
এদিকে, ইসলামপন্থি দলগুলোর মধ্যে কেউ কেউ শরিয়া আইন প্রবর্তনের দাবি তুলেছে, আবার কেউ কেউ নারী অধিকারে পরিবর্তনের প্রস্তাবও দিচ্ছে। কেউ কেউ বড় দলের সঙ্গে নির্বাচনি জোট গঠনের চিন্তাও করছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এদের উত্থান রাজনীতিকে আরও বিভক্ত করতে পারে, যদিও ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক দলগুলো নির্বাচনে সফলতা পায়নি।
শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে ভারত বাংলাদেশের প্রধান কৌশলগত মিত্র ছিল। কিন্তু তার পতনের পর, ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকার চীনের দিকে কিছুটা ঝুঁকেছে। চীনে তার প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদান বিষয়ে চুক্তি হয়েছে।
ভারত, বিপরীতে, হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ভালোভাবে নেয়নি। শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের অনুরোধে সাড়া না দিয়ে, বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসা কার্যত বন্ধ করে দিয়েছে দিল্লি।
তবে, পশ্চিমা বিশ্ব এবং জাতিসংঘের কাছ থেকে ইউনূস সরকার এখনও সমর্থন পাচ্ছে বলেই ধারণা বিশ্লেষকদের।
কুগেলম্যান অবশ্য সতর্ক করে বলেন, বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে ‘ট্রাম্প ফ্যাক্টর’। জানুয়ারিতে ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্তে ইউএসএআইডি'র তহবিল স্থগিত হয়ে যায়, যা ইউনূস সরকারের জন্য বড় ধাক্কা। তিনি বলেন, “ঢাকাকে এখন এমন একটি মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে হবে, যারা বাংলাদেশকে কেবল বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখে।”
এন কে/বিএইচ
