অভ্যুত্থানের অগ্নিকুণ্ড: আজও স্মরণে যাত্রাবাড়ীর রক্তাক্ত দিনগুলো


সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা ব্যাপক আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয় আওয়ামী লীগ সরকার। সেই ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। জনতার প্রবল চাপ ও ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধে গত বছরের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং পরবর্তীতে ভারতে আশ্রয় নেন।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে ঢাকার যাত্রাবাড়ী ও আশপাশের এলাকাগুলোতে ঘটে যাওয়া গণআন্দোলনের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় শুরু হওয়া এই আন্দোলন পরে রূপ নেয় ব্যাপক ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে, যার অন্যতম হটস্পট ছিল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী। তীব্র প্রতিরোধের মুখে অবশেষে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং দেশ ছাড়েন।
কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র সংগঠন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ৭ জুলাই শুরু করে ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে সর্বাত্মক কর্মসূচি। মূল দাবি ছিল, সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধান অনুযায়ী সংরক্ষণ সীমিত করা। এই কর্মসূচি ১৩ জুলাই পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে চললেও, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর হস্তক্ষেপ ও ছাত্রলীগের হামলায় আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
১৬ জুলাই থেকে যাত্রাবাড়ীর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নামে আন্দোলনকারীরা। প্রথমে শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি থাকলেও ১৭ জুলাই বিকেল থেকে পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায় আগুন দেওয়া হয়। ১৮ ও ১৯ জুলাই কাজলা, রায়েরবাগ ও শনির আখড়ায় টানা সংঘর্ষ হয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। টিয়ারশেল ও ছররা গুলিতে বহু শিক্ষার্থী নিহত ও আহত হন। আন্দোলনকারীরা এক পর্যায়ে কদমতলী থানা দখলের চেষ্টা করে। পুলিশ সদস্যদের মারধর ও হত্যার অভিযোগও ওঠে। রায়েরবাগ ওভারব্রিজে ঝুলিয়ে রাখা হয় নিহত দুই পুলিশ সদস্যের মরদেহ। আন্দোলনকারীদের দমন করতে আকাশ থেকেও গুলি চালানো হয় বলে জানা গেছে।
১৯ জুলাই মধ্যরাতে সরকার দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে। এরপর যাত্রাবাড়ীতে শুরু হয় যৌথ বাহিনীর অভিযান। র্যাব, পুলিশ ও বিজিবি যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে আন্দোলনকারীদের সরাতে চেষ্টা চালায়। ২০ জুলাই থেকে শুরু হওয়া এই অভিযান চলতে থাকে টানা ২-৩ দিন। বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, গুলিতে বহু মানুষ নিহত হন এবং অনেককে রাতের অন্ধকারে গুম করা হয়।
৪ আগস্ট থেকে শুরু হয় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। পরদিন ৫ আগস্ট হাজারো মানুষ যাত্রাবাড়ী থেকে ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নিতে রাজধানীমুখী হলে চৌরাস্তার কাছে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, শুধু যাত্রাবাড়ীতেই ওই দিন অর্ধশতাধিক মানুষ নিহত হন। আন্দোলনকারীরা যাত্রাবাড়ী থানা দখল করে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই ঘটনায় ছয়জন পুলিশ সদস্য নিহত হন।
আন্দোলনের এক বছর পরও যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ, শনির আখড়া ও কাজলায় আন্দোলনের স্মৃতি জীবন্ত। স্থানীয় বাসিন্দা মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, "সব কিছু চোখের সামনে ঘটেছে। পুলিশ গুলি চালিয়েছে, আবার আন্দোলনকারীরা থানা ঘিরে রেখেছে। এমন দৃশ্য জীবনে দেখিনি।"
শনির আখড়ার ব্যবসায়ী শাহরিয়ার হোসেন জানান, ২০ জুলাই চারদিকে শুধু গুলির শব্দ। হেলিকপ্টার থেকেও গুলি চলেছে। মানুষ মারা গেছে, কতজন হিসাব নেই।
২০২৪ সালের সেই ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান শুধু সরকারের পতনই ডেকে আনেনি, সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে একত্রিত করেছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে। যাত্রাবাড়ী ছিল সেই প্রতিরোধের প্রতীক। এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখানকার মানুষের স্মৃতিতে এখনও স্পষ্ট সেই রক্তাক্ত জুলাই।
