কীটনাশক ব্যবহারে সর্বনাশ


নারায়ণগঞ্জ জেলার চার উপজেলায় সবজি ক্ষেতে ব্যাপক হারে কীটনাশক ব্যবহার বাড়ছে। বিগত ২০১২ সালে ৪ উপজেলায় প্রায় ২ কোটি টাকার কীটনাশক বিক্রি হয়েছিলো। কীটনাশক বিক্রেতাদের তথ্যমতে বর্তমানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ৫ কোটি টাকার কীটনাশক বিক্রি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। অধিক কীটনাশক ব্যবহারে পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে। হুমকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ২০১১-২০১২ সালের জরিপ অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জের ৪ উপজেলায় মোট আবাদী জমির পরিমাণ ছিলো ৫০ হাজার ৮৫৭ হেক্টর।
২০২৪-২০২৫ সালের জরিপে তা কমে হয়েছে ৩৬ হাজার ১৯০ হেক্টর। কীটনাশক ব্যবহার বৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করে কৃষি বিভাগগুলো জানায়, অধিক ফলনের আশায় মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে কৃষক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিক ফলনের আশায় সবজিতে কীটনাশক ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছেন কৃষকরা। এ ক্ষেত্রে কীটনাশক ব্যবহারের বিধিও মানা হচ্ছে না। ফলে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের জন্য একদিকে যেমন সবজি আবাদে খরচ বাড়ছে। আবার অধিক মূল্যে ক্রয় করা কীটনাশক মিশ্রিত সবজি খেয়ে মানুষ পেটের পীড়াসহ নানা ধরণের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
কৃষকরা জানান, নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার, সোনারগাঁও ও বন্দর উপজেলায় ব্যাপকহারে বেগুন, পটল, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গে, লাউ, শীম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, চালকুমড়া, করলা, বরবটি, ডাটাশাক, লালশাক প্রভৃতি সবজির আবাদ হচ্ছে। এসব সবজিতে এডমায়ার, ভিতত্তিকা, এমাজিন, শেকল, ডায়াভিট মের্টাল, ডায়োজিন, এডমায়ার, ডেসিস, কারটাপসহ মানব দেহের মারাত্মক ক্ষতিকর কীটনাশক।
উপজেলা কৃষি অফিসগুলো সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের ৪ উপজেলায় ২৪৮ টি কীটনাশক দোকান ব্যবসা করে। গত বছর এরা ৩ কোটি টাকার মতো ব্যবসা করেছে। তখন আবাদি জমির পরিমাণও বেশি ছিলো। এখন জমির পরিমাণ কমলেও বেড়েছে দোকান এবং কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ। কীটনাশক দোকানগুলো প্রয়োজনে অপ্রোয়জনে কৃষকদের কীটনাশক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করে। কীটনাশকের ব্যবহার কমানো ও পরিবেশবান্ধব ফসল উৎপাদনের উদ্দেশ্যে কৃষি বিভাগের গাফিলতিই দায়ী বলে মনে করছেন অনেকে। তারপরও কীটনাশক ব্যবহার কমাতে হলে আইপিএম পদ্ধতিকেই আরো কার্যকর করা জরুরি বলে মনে করেন সবজি চাষীরা।
চার উপজেলার কৃষি অফিসগুলো সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের ৪ উপজেলায় বছরে ৫২১ টনেরও বেশি রাসায়নিক সার এবং ৬৩৫ টন কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। কৃষকরা বেশি ফলনের আশায় ক্ষেতে সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মানা হয় না কোনো নিয়মনীতি।
চার উপজেলার প্রায় ৪১ জন কৃষকের সঙ্গে কথা হয়েছে এ প্রতিবেদকের। তাদের সঙ্গে কথা বলে যতটুকু বুঝা গেছে, বস্তুত কতটুকু জমিতে কী পরিমাণ সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় এবং ব্যবহারের কতদিন পর ফসল উত্তোলন করতে হয়, এসব বিষয়ে সিংহভাগ কৃষকের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান নেই। রূপগঞ্জের বাগবাড়ী এলাকার কৃষক ধলু মিয়া বলেন, আমি সবজি লাগাই ২০ বছর ধইরা। কোন দিন কোন অফিসার আইয়া খোঁজখবর লয় নাই। নিজে যেমুন বুঝি তেমুন সার ওষুধ দেই ক্ষেতে। আড়াইহাজার উপজেলার উচিৎপুরা এলাকার কৃষক মনিরুল ইসলাম বলেন, এতো কিছু বুঝি না। ক্ষেত লাগাই, যেটুক মন চায় হেইটুক সার ও ওষুধ দেই। আর কি ক্ষতি অয় হেইডা কেমনে কমু। সোনারগাঁও উপজেলার আমগাঁও এলাকার কৃষক শাহীন মিয়া বলেন, আমি সবজি করি ১৪ বছর অইছে। কোন দিন কৃষি অফিসার আহে নাই। নিজে বুইজ্জা ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহার করি।
রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ রনি বলেন, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক রয়েছে। প্রথমত, এতে মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যপণ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধীরে ধীরে বিকল হয়ে পড়ে। ব্রঙ্কাইটিসসহ শ্বাসযন্ত্রে নানা জটিলতা দেখা দেয়। অনেকেই কিডনি ও লিভারের রোগে আক্রান্ত হয়। এমনকি গর্ভবতী মায়েরা ত্রুটিযুক্ত বা অসুস্থ সন্তান জন্ম দেন। দ্বিতীয়ত, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের প্রভাব পড়ছে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ফসলের মাঠ গড়িয়ে নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়ে গিয়ে মাছের মৃত্যুর কারণ ঘটাচ্ছে। শুধু মাছ নয়, অনেক পাখি ও প্রাণীও হারিয়ে যাচ্ছে বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণে। অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে ভবিষ্যৎ ফসল উৎপাদন ক্ষেত্রেও। কারণ এতে কমে যাচ্ছে জমির উর্বরতা শক্তি। মরে যাচ্ছে ফসলের জন্য উপকারী পোকা।
কৃষকরা অভিযোগ করে বলেন, নামমাত্র প্রশিক্ষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ কৃষি অফিস। তাদের দাবি, স্বাস্থ্যবিধি মানতে ব্যবহৃত সরঞ্জামের জোগান দিতে হবে কৃষি অফিসকে। কৃষি অফিসের পর্যাপ্ত সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ করে কৃষকরা বলেন, ফসলে যে কীটনাশক ব্যবহার করি, তা ঠিকমতো ধোয়া হয় না। আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা হয়েছে। তবে কৃষি অফিস যদি আমাদের মেশিন কিনে দিত, তাহলে আমরা রোগবালাই থেকে রেহাই পেতাম। ভোলাব ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোঃ ছামাদ মিয়া বলেন, আমরা সারাক্ষণ মাঠে থাকি। কৃষকদের বুঝানো যায় না। ওনারা কীটনাশক বেশি ব্যবহার করেন। যেনো পোকা না ধরে। পোকার কারণে ফলন কম হবে এ কারণে তারা সার ও কীটনাশক বেশি দেয়।
রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ম্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ আইভি ফেরদৌস বলেন, এসব কীটনাশক ব্যবহারের কমপক্ষে এক সপ্তাহ পর সবজি গ্রহণ করতে হবে। যা কৃষকেরা মানছেন না। কীটনাশক মিশ্রিত সবজি খেয়ে মানুষের নার্ভার সিসটিমে আঘাত করছে। এর ফলে হাত-পা কাঁপা, মাথাকাঁপা, প্যারালাইসেস হওয়া, কিডনি ফেল করা, শ্বাসকষ্ট, হার্ট অ্যাটাক, চর্মরোগসহ ক্যান্সার জাতীয় রোগ হতে পারে। রূপগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার আফরোজা সুলতানা বলেন, আসলে কৃষকরা ভাল ফলনের আশায় বেশি কীটনাশক ব্যবহার করে। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা চেষ্টা করেছি তাদের সচেতনতা করতে। ঠিকঠাক মতো আমরা প্রশিক্ষণও দেই। এখন কৃষকরা যদি না মানে আমাদের কি করার আছে।
আড়াইহাজার উপজেলার কৃষি অফিসার মাহমুদুল হাসান ফারুকী, সোনারগাঁও উপজেলার কৃষি অফিসার আফরোজা সুলতানা একই কথা বলেছেন। নারায়ণগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মুহাম্মদ শাহ আলম বলেন, বিভিন্ন প্রশিক্ষণে কৃষকদের সার ও কীটনাশক ব্যবহারের নিয়ম-কানুন বলা হয়। কিন্তু তারা যদি না মানে তাহলে তো কিছু করার নেই। তারা অধিক ফলনের আশায় অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করে।
নতুন/কাগজ/রায়হানা/সুলতানা/রূপগঞ্জ
