শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
Natun Kagoj

পুণ্যাহ থেকে হালখাতা—বাঙালির রাজস্ব উৎসবের বিবর্ণ ইতিহাস

পুণ্যাহ থেকে হালখাতা—বাঙালির রাজস্ব উৎসবের বিবর্ণ ইতিহাস
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

বাংলা নববর্ষ মানেই বাঙালির প্রাণের উৎসব—তাতে যেমন আছে মঙ্গল শোভাযাত্রা, পান্তা-ইলিশ, তেমনি আছে আরেকটি ঐতিহ্যবাহী অনুষঙ্গ: হালখাতা। একসময় গ্রাম থেকে শহর, নগর থেকে মহানগর—সব জায়গাতেই পহেলা বৈশাখ মানেই ছিল পুরোনো দেনা-পাওনা মিটিয়ে নতুন হিসাবের খাতা খোলা। আজকের দিনে এসে সেই প্রথা হারিয়ে যাচ্ছে আধুনিকতার ধাক্কায়, তবুও পুরান ঢাকার অলিগলিতে এখনো তার ক্ষীণ অস্তিত্ব বেঁচে আছে, ধুঁকে ধুঁকে।

এক সময় হালখাতা ছিল নববর্ষের এক বড় উৎসব। দোকান সাজানো, কাস্টমার আপ্যায়ন, মিষ্টিমুখ, পূজা, উপহার—সবকিছু মিলিয়ে এক উৎসবমুখর পরিবেশ। তবে সময়ের পরিবর্তনে, নগদ অর্থপ্রবাহ ও ডিজিটাল লেনদেনের যুগে হালখাতার প্রয়োজনীয়তা যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে আগ্রহ।

ঐতিহ্যের শেকড়
হালখাতার শেকড় প্রাচীন মোগল আমলে। সম্রাট আকবরের সময় রাজস্ব আদায়ে কৃষকের দুর্ভোগ লাঘব করতে চালু হয় বাংলা সন। এরপর থেকেই ব্যবসায়িক হিসাব-নিকাশের জন্য চালু হয় ‘হালখাতা’। ‘হাল’ শব্দের অর্থ সংস্কৃতে লাঙল আর ফারসিতে ‘নতুন’। হালখাতা তাই হয়ে উঠেছিল ফসলভিত্তিক অর্থনীতির অঙ্গ এবং নববর্ষের আত্মিক অনুষঙ্গ।

চৈত্র সংক্রান্তিতে পুরোনো হিসাব গুছিয়ে পহেলা বৈশাখে নতুন খাতা খোলা হতো। প্রজারা জমিদারের দরবারে গিয়ে খাজনা দিতেন। ব্যবসায়ীরা তখন তাদের খরিদ্দারদের আমন্ত্রণ জানিয়ে হালখাতা করতেন—যেখানে গ্রাহকরা দেনা শোধ করতেন আর ব্যবসায়ী মিষ্টিমুখ করিয়ে দিতেন নতুন বছরের উপহার।

পুরান ঢাকার প্রাণে এখনো বেঁচে আছে
আজও পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার, শ্যামবাজার, চকবাজার, ইসলামপুর, বাদামতলী এলাকায় অনেক দোকানে হালখাতা অনুষ্ঠিত হয়। তাঁতীবাজারের এক গয়নার দোকানের ম্যানেজার মিলন ঘোষ বলেন, "১৪ ও ১৫ এপ্রিল হালখাতার আয়োজন করছি। সরকারি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৪ এপ্রিল, আর সনাতন ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী ১৫ এপ্রিল পূজাসহ হালখাতা হয়। দোকান সাজানো হয়, কাস্টমারদের উপহার দেওয়া হয়, মিষ্টিমুখ করানো হয়।"

শ্যামবাজারের ব্যবসায়ী ওবায়দুল ইসলাম মানিক জানান, "আগে নির্দিষ্ট দিনে সবাই একসঙ্গে হালখাতা করলেও এখন গ্রাহকদের সুবিধার্থে আলাদা দিনে করেন অনেকেই। ঈদের আগে-পরে সবাই নিজের সময় মতো হালখাতা করেন। কেউ কেউ কয়েক বছরের দেনা একসঙ্গে মেটান, কেউ আংশিক দেন। যা বাকি থাকে তা নতুন খাতায় তোলা হয়।"

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও পুণ্যাহ উৎসব
হালখাতার ঐতিহাসিক উৎস ছিল ‘পুণ্যাহ’ নামে পরিচিত একটি রাজস্ব উৎসব। নবাবি আমলে ঢাকায় ভাওয়াল রাজার কাচারিবাড়ি, রূপলাল হাউস প্রভৃতি জায়গায় বিশাল আয়োজন হতো। খাজনা আদায় হতো উৎসবের মধ্য দিয়ে। নবাবের দরবারে উপস্থাপিত হতো স্বর্ণখচিত খাতা—প্রতীকীভাবে রাজস্ব বছরের সূচনা।

ধর্মীয় আচার ও রীতি
বিশেষ করে হিন্দু ব্যবসায়ীরা লক্ষ্মী-গণেশ পূজা করতেন হালখাতার দিনে। দোকানে ধূপধুনা, স্বস্তিক চিহ্ন আঁকা, নতুন খাতায় সিঁদুরের ছাপ, চন্দনের ফোঁটা, এমনকি নতুন খাতাটি মন্দিরে নিয়ে গিয়ে পূজা—সবই ছিল এই রীতির অংশ।

নতুন প্রজন্মের অনীহা ও প্রযুক্তির চাপে বিপন্ন ঐতিহ্য
আজকের তরুণ ব্যবসায়ীরা হালখাতা নিয়ে খুব একটা আগ্রহী নন। অধিকাংশ লেনদেন এখন মোবাইল ব্যাংকিং বা ডিজিটাল মাধ্যমে হয়। ফলে বাকির খাতা আর নতুন করে খোলার দরকার পড়ে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, “আগে যেমন হাতে নগদ টাকার জন্য নববর্ষের সময় দেনা শোধ হতো, এখন মানুষ তাৎক্ষণিক লেনদেন করে। ফলে হালখাতা কেবল আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

হালখাতা আজ হয়তো অতীতের গৌরব হারিয়েছে, তবু পুরান ঢাকার দোকানে দোকানে লাল কাপড়ে মোড়া খাতায় এখনো বেজে ওঠে নববর্ষের সুর। এ যেন এক নিঃশব্দ প্রতিবাদ, স্মৃতির দেয়ালে খোদাই করে রাখা ইতিহাসের ছাপ—যা বাঁচিয়ে রেখেছে একটি জাতির ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে।


গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

সর্বশেষ