চট্টগ্রাম মেডিকেলে চিকিৎসা নয়, চলছে অব্যবস্থাপনার মহোৎসব


ডাক্তারদের অবহেলা, নার্স-আয়ার দুর্ব্যবহার, আনসারদের চাঁদাবাজি—অসহায় রোগীরা বলি, কর্তৃপক্ষ নির্বিকার
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল—দেশের অন্যতম বৃহৎ সরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। অথচ এখানেই যেন চলছে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক করুণ চিত্রনাট্য। চিকিৎসা যেখানে মানুষের শেষ আশ্রয়, সেখানে রোগী ও স্বজনদের ভাগ্যে জুটছে দুর্ব্যবহার, হয়রানি আর অর্থনৈতিক নিপীড়ন।
নারী ওয়ার্ডে পপি আক্তারের ফেসবুক স্ট্যাটাসে ফাঁস হয় বাস্তবতা
সম্প্রতি নারী ওয়ার্ডে ভর্তি পপি আক্তার নামের এক রোগী সামাজিক মাধ্যমে একটি হৃদয়বিদারক স্ট্যাটাস দেন। সেখানে উঠে আসে চিকিৎসার নামে অবহেলা ও অপমানের বাস্তব অভিজ্ঞতা। অনুসন্ধানে জানা যায়, রোগীর ছদ্মবেশে গিয়ে দেখা গেছে তার অভিযোগের বেশিরভাগই সত্য।
ডাক্তারদের অবহেলা: চিকিৎসার বদলে টেস্ট আর অপেক্ষা
ওয়ার্ডে সকালে হাতে গোনা কয়েকজন চিকিৎসক এলেও সারাদিন ওয়ার্ড থেকে তারা গায়েব। জ্বর, ব্যথা, সংক্রমণে ছটফট করা রোগীরা দিনের পর দিন পড়ে থাকে চিকিৎসাহীন। ওষুধ নয়, পরীক্ষা নয়, বরং টেস্ট আর রিপোর্টেই যেন নির্ভর করছে জীবন-মৃত্যুর সীমানা। 'ইমারজেন্সি' টেস্ট করাতেও ঘুষ দিতে হয়—সরাসরি কিংবা ইঙ্গিতে।
আয়া ও নার্সদের দুর্ব্যবহার: সেবার বদলে অবহেলা ও অপমান
রোগীরা একটু সহায়তা চাইলে জবাব আসে—“মেশিন নাই”, “সময় নাই”, “যা গিয়া ঘুমা”। নার্সদের আচরণে কোথাও দেখা মেলে না মমতার; যেন অসুস্থ মানুষগুলো বোঝা, অযাচিত ঝামেলা। খাবার পৌঁছায় না সবার মুখে, পেশেন্ট শিটেও থাকে না প্রয়োজনীয় তদারকি।
আনসারদের চাঁদাবাজি: নিরাপত্তার নামে হয়রানি
হাসপাতালে প্রবেশের সময় রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হচ্ছে নিয়মিত। কেউ ১০০ টাকা না দিলে আটকে রাখা হয়, গেট পার হতে দেয় না। কেউ প্রতিবাদ করলে জোটে অপমান বা হুমকি। অথচ কর্তৃপক্ষ নির্বিকার—নীরব সমর্থন যেন প্রতিষ্ঠানেরই নীতি হয়ে গেছে।
নারী ওয়ার্ডে নিরাপত্তার অভাব: অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা লজ্জা
রাতে নারী ওয়ার্ডে অনায়াসে ঢুকে পড়ে পুরুষ স্বজনেরা। অনেকেই রোগীর পাশে শুয়ে থাকে, কেউ কেউ রাতভর ঘোরাফেরা করে। ওয়ার্ডের ওয়াশরুমে নেই আলো, নেই পানি, নিরাপত্তা তো দূরের কথা। রোগীদের মৌলিক অধিকারও এখানে রক্ষা হয় না।
চিকিৎসা নয়, চলছে প্রেসক্রিপশন ও ওষুধ বাণিজ্য
সরকারি বরাদ্দের ওষুধ পাওয়া যায় না অধিকাংশ সময়। নার্সরাই বলে দেন—“ঔষধ নাই”। অথচ সেই ওষুধ বাইরে ফার্মেসিতে বিক্রি হচ্ছে। চিকিৎসকেরা প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত ওষুধ লিখে দেন, যা পরে ফেরত যায় নির্দিষ্ট ফার্মেসিতে—অর্থাৎ একটি সুপরিকল্পিত বাণিজ্যিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে হাসপাতালের ভিতরেই।
কর্তৃপক্ষের নির্লজ্জ অস্বীকার: ‘অতিরঞ্জিত’ বলেই দায় সারে
এইসব অনিয়ম, দুর্নীতি ও নির্যাতনের অভিযোগ বহুবার গণমাধ্যম এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানানো হলেও কর্তৃপক্ষ বরাবরের মতো সবকিছু অস্বীকার করে। তদন্ত নয়, ব্যবস্থা নয়—বরং অভিযোগকারীদের দোষারোপ করাই যেন চট্টগ্রাম মেডিকেলের রীতি।
রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার এই চিত্র কি স্বাভাবিক?
সরকারি হাসপাতাল দরিদ্র মানুষের শেষ ভরসা। কিন্তু যখন চিকিৎসার নামে চলে নির্যাতন, তখন তা শুধু অব্যবস্থাপনার চিত্র নয়—এটি এক মানবিক বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি।
চমেক কি মগের মুল্লুক?
ড. ইউনুসের সময় সাড়াশি অভিযান চালানো হলেও চট্টগ্রাম মেডিকেল আজও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। বরং অনিয়ম এখানে আরো গেড়ে বসেছে। জনসাধারণ প্রশ্ন করছে—চট্টগ্রাম মেডিকেল কি সরকারের আওতায়, নাকি এটি চালায় অদৃশ্য কোনো চক্র?
সময় এসেছে পদক্ষেপ নেওয়ার।
দ্রুত তদন্ত, জবাবদিহি এবং সংস্কার না হলে এই হাসপাতাল একদিন ‘মৃত্যুর কারখানা’ হয়ে উঠবে—যার দায় কেউ এড়াতে পারবে না।
নতুন/কাগজ/সালেহী/চট্টগ্রাম
