জেল খেটেও থামেনি প্রতারণা: কুমিল্লা থেকে রাজধানীজুড়ে রেজাউলের দৌরাত্ম্য
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ভয়াবহ প্রতারণা করে আসছে এক ব্যক্তি। নাম তার রেজাউল করিম। বর্তমানে সাংবাদিক পরিচয়ে ঘুরে বেড়ালেও, তার অতীত ও বর্তমান ঘাঁটলে বেরিয়ে আসে একের পর এক চাঞ্চল্যকর প্রতারণার কাহিনি। বিদেশে পাঠানোর লোভ দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া এই ব্যক্তি বর্তমানে কুমিল্লায় আত্মগোপনে রয়েছে বলে জানা গেছে।
রেজাউলের প্রতারণার কৌশল বেশ পুরনো হলেও কার্যকর। কখনো তিনি নিজেকে একটি ট্রাভেল এজেন্সির মালিক হিসেবে পরিচয় দেন, কখনো আবার বিদেশি ভায়ার নাম ব্যবহার করেন। রাজধানীর মতিঝিল, কাকরাইল, পল্টন, মালিবাগ, বনানী, মগবাজার, গুলশান, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় অফিস স্থাপন করে কিছুদিন পরে তা গুটিয়ে নতুন এলাকায় শুরু করেন নতুন প্রতারণা।
কুয়েত ও ইউরোপ পাঠানোর কথা বলে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ২০২০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিআইডির হাতে গ্রেপ্তার হন তিনি। সেদিন বিকাল ৪টা ৪৭ মিনিটে তাকে গ্রেফতার করা হয়। জেল খেটে বের হওয়ার কিছুদিন পরেই আবারো শুরু করেন পুরানো খেলা। বনানীর আকাশ নামে এক যুবকের কাছ থেকে ফিজি নামক রাষ্ট্রে পাঠানোর কথা বলে দেড় লক্ষ টাকা নিয়ে ভুয়া কাগজ ধরিয়ে দেন। এরপর গা ঢাকা দেন এই প্রতারক।
২০২৩ সালের ১ জুলাই মতিঝিল এলাকা থেকে আবারও ‘কুয়েত ভিসা’ দেয়ার নামে শতাধিক মানুষের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা নিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান রেজাউল। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী ছিলেন নরসিংদী জেলার রাজিব আহামেদ। তিনি জানান, কুয়েত ভিসার জন্য রেজাউলকে ছয় লক্ষ টাকা দেন। ফ্ল্যাইটের তারিখ দেয়ার কথা ছিল ২৮ আগস্ট। কিন্তু তার আগেই রেজাউল মোবাইল ও অফিস বন্ধ করে পালিয়ে যান।
রেজাউলের বিরুদ্ধে ঢাকার পল্টন থানায় ও নরসিংদী জজ কোর্টে একাধিক মামলা আছে। অভিযোগ আছে, তিনি কুমিল্লার আদর্শ দুর্গাপুর এলাকায় ইউটিউব সাংবাদিকের পরিচয় দিয়ে লুকিয়ে আছেন। সেখানেও তার বিরুদ্ধে চলছে চাঁদাবাজি, ব্ল্যাকমেইলিং ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ।
স্থানীয়দের মতে, রেজাউল পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে চলে। কিছু পুলিশ সদস্য তাকে সহায়তা করেন, যার ফলে এত অভিযোগ থাকার পরেও কেউ তাকে গ্রেফতার করে না। বরং যারা তার বিরুদ্ধে মুখ খোলে, তাদের নামে মিথ্যা মামলা, অস্ত্র মামলা কিংবা ডাকাতির অভিযোগ এনে হয়রানি করা হয়।
বর্তমানে রেজাউল নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ইউটিউবে চ্যানেল চালান। এই পরিচয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে চাঁদা আদায় করছেন সাধারণ মানুষ থেকে। কুমিল্লার ট্রাক চালক আবু হানিফার কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন রেজাউল। টাকা না দেয়ায় তার নামে একের পর এক মিথ্যা সংবাদ প্রচার করছেন। এমনকি মিথ্যা ডাকাতি মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টাও করছেন।
অতীত থেকে বর্তমান: প্রতারণার এক ভয়াবহ চিত্র
২০১০ সাল থেকে রেজাউলের প্রতারণা শুরু হয়। তখন থেকেই তিনি ‘ট্রাভেল এজেন্সি’ খুলে বিদেশে পাঠানোর নামে মানুষের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, কুয়েত—সব দেশের ভিসা দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে অসংখ্য মানুষকে সর্বস্বান্ত করেছেন। একেক সময় একেক এলাকায় অফিস খুলে প্রতারণা করেন। মতিঝিল, শাহজাহানপুর, কাকরাইল, পল্টন, বনানী, মালিবাগ, মিরপুর—কোনো এলাকাই বাদ যায়নি।
বিভিন্ন সময়ে তাকে সিআইডি গ্রেপ্তার করা হলেও, জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আরও শক্তভাবে ফিরে এসেছেন তিনি। তার নেটওয়ার্ক এতটাই বিস্তৃত যে থানার পুলিশ পর্যন্ত তার হয়ে কাজ করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সাধারণ মানুষরা অভিযোগ করলেও রেজাউল বেশিরভাগ সময় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। কারণ, তিনি পুলিশ, স্থানীয় কিছু সাংবাদিক ও রাজনৈতিক মহলের সহায়তা পান। ফলে নিরীহ ভুক্তভোগীরা আইনের আশ্রয় নিয়েও ন্যায়বিচার পান না। বরং উল্টো হয়রানির শিকার হন।
রেজাউলের মত প্রতারকদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে সাধারণ মানুষ আইন ও প্রশাসনের ওপর থেকে ভরসা হারাবে। শুধুমাত্র সাংবাদিক পরিচয় থাকলেই কেউ ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে—এমন নজির বারবার তৈরি হলে সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়বে। এ ধরনের প্রতারকদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে যথাযথ শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
রেজাউল শুধু একজন প্রতারক নয়, বরং একজন ঠান্ডা মাথার অপরাধী, যে সাধারণ মানুষের সরলতা ও স্বপ্নকে হাতিয়ার করে গড়ে তুলেছে এক বিশাল প্রতারণা সাম্রাজ্য। এখন সময় এসেছে তার মুখোশ খুলে তাকে আইনের আওতায় আনার। নতুবা ভবিষ্যতে আরও অনেক রেজাউলের জন্ম হবে, আর বিপদে পড়বে অসংখ্য নিরীহ মানুষ।
এ বিষয়ে রেজাউলের বক্তব্য জানতে তার মোবাইল নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তার ব্যবহৃত নম্বরটি বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
