শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫
Natun Kagoj
১৬ কর্মকর্তাকে দায়মুক্তি

পাসপোর্ট পরিচালকের বেপরোয়া সিন্ডিকেট ‘মাসোহারা প্রায় ১২ কোটি’

পাসপোর্ট পরিচালকের বেপরোয়া সিন্ডিকেট ‘মাসোহারা প্রায় ১২ কোটি’
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের ৬৯টি অফিস থেকে ‘মাসোহারা’ বাবদ ‘কালেকশন’ হচ্ছে প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির একজন পরিচালকের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এ অর্থ আদায় এবং ভাগ-বাটোয়ারা হয়। একটি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এ সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রতিবেদন উঠে আসে। 

সংশ্লিষ্ট ২৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রতিবেদনটি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হয়। কিন্তু দুদক দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়ে মামলা দায়ের করে ৭/৮ জনের বিরুদ্ধে। অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিশেষ বোঝাপড়ার ভিত্তিতে দায়মুক্তির সনদ নেন অন্তত ১৬ কর্মকর্তা। অধরা পাসপোর্ট কর্মকর্তারা এখন বিপুল উদ্যোমে শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করে বেপরোয়াভাবে অব্যাহত রেখেছেন দুর্নীতি। তথ্য নির্ভরযোগ্য সূত্রের।

সূত্রটি জানায়, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অন্তত ২৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অনুসন্ধানের জেরে পাসপোর্টের বহু কর্মচারী, অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আত্মীয়-স্বজনসহ বিভিন্ন জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলবি নোটিশ করা হয়। সংগ্রহ করা হয় অনেক রেকর্ডপত্রও। এর মধ্যে কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা করলেও ‘বিশেষ বোঝাপড়া’র ভিত্তিতে গত দুই বছরে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে অন্তত ১৬ কর্মকর্তাকে। তথ্য নির্ভরযোগ্য সূত্রের।

গোয়েন্দা প্রতিবেদন মতে, ২৫ লাখ টাকা পকেটে না নিয়ে ঘরে ফিরতেন না পাসপোর্টের ‘জি-২৫’ সিন্ডিকেট ভুক্ত কর্মকর্তারা। গোয়েন্দা সংস্থাটি সিন্ডিকেটভুক্ত 
পাসপোর্ট কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিস্তর-বিত্তান্ত উল্লেখ করে ২০১৮ সালে একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করে। এর ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে ২০১৯ সালে প্রতিবেদনটি পাঠানো হয় দুদকে। এতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের ‘বাংলাদেশি নাগরিক’ পরিচয়ে হাজার হাজার পাসপোর্ট ইস্যু করেছেন পাসপোর্টের উল্লেখিত কর্মকর্তারা। এছাড়া ভারতীয় নাগরিকদের নামে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ইস্যু, একই ব্যক্তির বিভিন্ন নামে একাধিক পাসপোর্ট প্রদান, দালাল-সিন্ডিকেট প্রতিপালন, পদোন্নতি প্রদান, প্রাইজ পোস্টিং, পাসপোর্ট সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্পসহ বিভিন্নভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল পাসপোর্টের বিভিন্ন অফিসে কর্মরত সিন্ডিকেটভুক্ত এসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। প্রতিবেদনে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের তৎকালীন অতিরিক্ত মহা-পরিচালক (এডিজি) এটিএম আবু আসাদসহ ২৪ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে যে তথ্য পাওয়া যায় সেসবের বিবরণ ছিল। গোয়েন্দা সংস্থার মুখোমুখি হওয়া কর্মকর্তারা কে কোন পদ্ধতিতে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন এবং কে, কোথায়, কী পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন সেসবের স্বীকারোক্তি রয়েছে। এদের মধ্যে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০২১ সালে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের তৎকালীন অতিরিক্ত মহা-পরিচালক (এডিজি) এ টি এম আবু আসাদকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বাকিদের বিষয়ে দুদকে চলছিল অনুসন্ধান। যাদের বিরুদ্ধে দুদক অনুসন্ধান শুরু করে তাদের মধ্যে ছিলেন, পাসপোর্ট ও পরিকল্পনা শাখার তৎকালীন উপ-পরিচালক মো. শাহাদাৎ হোসেন, সে সময় ই.পাসপোর্ট এবং স্বয়ংক্রিয় বর্ডার কন্ট্রোল ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন প্রকল্পের উপ-পরিচালক রোজী খন্দকার, নোয়াখালি পাসপোর্ট অফিসের তৎকালীন পরিচালক এ কে এম মাজহারুল ইসলাম, চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক মো. আবু সাঈদ, উপ-পরিচালক বিপুল গোস্বামী, উপ-সহকারী পরিচালক মোত্তালেব সরকার, পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) মো. শিহাবউদ্দিন খান, পরিচালক মো: সাইদুল ইসলাম, পরিচালক মোহাম্মদ তৌফিকুল ইসলাম খান, উপ-পরিচালক নাদিরা আক্তার, উপ-পরিচালক শাহ মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ, উপ-পরিচালক মহের উদ্দিন শেখ, উপ-পরিচালক নূরুল হুদা, উপ-পরিচালক মাসুম হাসান, কুমিল্লার তৎকালীন সহকারী পরিচালক শামীম, শফিকুল ইসলাম গিয়াস, উচ্চমান সহকারী মিজান শিকদার, সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) আজিজুল ইসলাম, সিস্টেম এনালিস্ট নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মাসুদ রানা এবং ডাটা এন্ট্রি অপারেটর শাহজালাল ছিলেন। অনুসন্ধান শেষে তৎকালীন সহকারী পরিচালক আবজাউল আলমসহ ৮ কর্মচারী, উপ-সহকারী মোতালেব সরকার, তার স্ত্রী ইশরাত জাহান, পাসপোর্ট পরিচালক মো: তৌফিকুল ইসলাম, পরিচালক আব্দুল্লাহ আল-মামুন এবং উপ-পরিচালক মাসুম হাসানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পর্যায়ক্রমে মামলা করে দুদক। 

সহকারী পরচালক মো.আবজাউল আলমসহ ৮ কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের তৎকালীন সহকারী পরিচালক (বর্তমানে উপ-পরিচালক) মামুনুর রশিদ চৌধুরী। মোতালেব হোসেন সরকার এবং তার স্ত্রী ইশরাত জাহানের বিরুদ্ধে পৃথক মামলা করেন দুদকের উপ-পরিচালক আবু বকর সিদ্দিক। মোহাম্মদ তৌফিকুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো: সাইদুজ্জামান। পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের তৎকালীন উপ-পরিচালক ফরিদ আহম্মেদ পাটোয়ারি।

অন্যদিকে অধরাই থেকে গেছেন পাসপোর্টের প্রভাবশালী পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মো: শিহাব উদ্দিন খান, পরিচালক (পাসপোর্ট, ভিসা ও পরিদর্শন) এ কে এম মাজহারুল ইসলাম, পরিচালক (চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়) মো. সাইদুল ইসলাম, পরিচালক (খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়) মো. আবু সাইদ, উপ-পরিচালক (ভিসা শাখা, প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত) নাদিরা আক্তার, উপ-পরিচালক (প্রধান কার্যালয়) শাহ মুহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ, উপ-পরিচালক (সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়) মহের উদ্দিন শেখ, উপ-পরিচালক নূরুল হুদা, উপ-পরিচালক (অর্থ ও নিরীক্ষা, প্রধান কার্যালয়) বিপুল কুমার গোস্বামী, উপ-পরিচালক রাজ আহমেদ, উপ-পরিচালক (ময়মনসিংহ) শাহাদাৎ হোসেন এবং উপ-পরিচালক (নোয়াখালি) রোজী খন্দকারসহ ১৬ কর্মকর্তা। জানা গেছে, দুদকের দুর্নীতিগ্রস্ত কয়েকজন কর্মকর্তা বিশেষ বোঝাপড়ার ভিত্তিতে তাদের দায়মুক্তি প্রদানের ‘ব্যবস্থা’ করেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখিত সুনির্দিষ্ট অভিযোগের বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট দুদক কর্মকর্তারা আমলে না নিয়ে কিংবা গভীর অনুসন্ধানে না গিয়ে দিকে না গিয়ে মামলা রুজুর পরিবর্তে ‘সাফাই প্রতিবেদন’ দাখিল করেন। বিপরীতে পাসপোর্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা।

এদিকে দুদক বেশ কয়েক জনের বিরুদ্ধে মামলা করলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপরস্থ কর্মকর্তাদের হাত করে পরিচালক মো. শিহাবউদ্দিন খান গোটা ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরে সৃষ্টি করেছেন দুর্নীতির শক্তিশালী সিন্ডিকেট। পাসর্পোটের মাজহারুল ইসলাম, সাইদুল ইসলাম, আবু সাইদ, নাদিরা আক্তার, ওয়ালিউল্লাহ এবং মহের উদ্দিন শেখ তার দুর্নীতির বিশ্বস্ত কর্মকর্তা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ অফিস থেকে এই সিন্ডিকেট আদায় করছেন মাসোহারা।

প্রতিবেদন মতে, পরিচালক শিহাবউদ্দিন খানের সিন্ডিকেট আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস থেকে প্রতি মাসে তুলছেন ১ লাখ ষাট হাজার টাকা। কেরাণীগঞ্জে অবস্থিত যাত্রাবাড়ী অফিস থেকে ৩০ হাজার টাকা, ময়মনসিংহ থেকে ৮০ হাজার টাকা, কুমিল্লা থেকে মাসভেদে এক থেকে ৪ লাখ টাকা, মনসুরাবাদ থেকে ২ লাখ টাকা, চান্দগাঁও, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নারায়ণগঞ্জ থেকে ১ লাখ টাকা করে, সিলেট ও মৌলভীবাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা করে, মাদারীপুর ও বরিশাল পাসপোর্ট অফিসথেকে ২০ হাজার টাকা করে, বগুড়া থেকে ১৫ হাজার টাকা, হবিগঞ্জ থেকে ৫০ হাজার টাকা, নরসিংদী থেকে ২৫ হাজার, ফরিদপুর থেকে ২০ হাজার, সুনামগঞ্জ থেকে ১৫ হাজার, সাতক্ষীরা থেকে ১৫ হাজার, নোয়াখালী থেকে ১ লাখ, যশোর থেকে ৫০ হাজার, লক্ষ্মীপুর থেকে ১৫ হাজার, কুষ্টিয়া ও শরীয়তপুর থেকে ১০ হাজার টাকা করে, চাঁদপুর থেকে ১৫ হাজার, ঝিনাইদহ থেকে ১০ হাজার, বাগেরহাট থেকে ১০ হাজার, রাজশাহী থেকে ১৫ হাজার এবং মুন্সীগঞ্জ থেকে ১৫ হাজার টাকা নিয়মিত মাসোহারা তুলছেন।


ইনকিলাব
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

আরও পড়ুন