বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
Natun Kagoj
প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহারে জনদুর্ভোগ:

রাজউকের পরিচালক শামীমা মোমেনকে ঘিরে দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট

রাজউকের পরিচালক শামীমা মোমেনকে ঘিরে দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)-এর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচালক শামীমা মোমেন দীর্ঘদিন ধরে এক প্রভাবশালী পদে বহাল থাকলেও তাঁর কার্যক্রম নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। 

অভিযোগ রয়েছে, তাঁকে ঘিরে রাজউকে গড়ে উঠেছে একটি সংঘবদ্ধ দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট, যারা ফাইল আটকে রেখে উৎকোচ আদায়, নকশা অনুমোদনে অনিয়ম, প্লট বরাদ্দে পক্ষপাতিত্ব এবং প্রভাব খাটিয়ে সুবিধাভোগীদের অগ্রাধিকার দিচ্ছে। বর্তমানে তিনি জোন-৬ এর পরিচালক হিসেবে কর্মরত। এর আগে শামীমা মোমেন পরিচালক (বোর্ড, জনসংযোগ ও প্রটোকল) এ দায়িত্ব পালন করেছেন। এখানে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করাকালীন গড়ে তুলেন একটি দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট। যার নেতৃত্বে রয়েছেন রাজউকের বেশ কয়েকজন ইমারত পরিদর্শক। 

শামীমা মোমেন রাজউকে একজন অভিজ্ঞ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। তবে অভিজ্ঞতা আর দায়িত্বশীলতার আড়ালে তিনি এক ক্ষমতাধর "ফাইল নিয়ন্ত্রক" হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন। অভিযোগ রয়েছে, তাঁর টেবিলে থাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের অনুমোদন ইচ্ছাকৃতভাবে আটকে রাখা হয়—যতক্ষণ না 'সুনির্দিষ্ট অঙ্কের সুবিধা' নিশ্চিত করা যায়।

রাজউকের একাধিক অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, শামীমা মোমেন কোনো নকশা অনুমোদনের আগে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী বা স্থপতিদের ‘বিশেষ লোকের’ সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। সেই লোকই পরে ঠিক করে দেন ‘ফি’ কত হবে। এতে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়, সেবাগ্রহীতারা হয়রানির শিকার হন।

নকশা অনুমোদনে গোপন দরবাজি
রাজউকের মূল দায়িত্বগুলোর মধ্যে একটি হলো নির্দিষ্ট নিয়ম ও আইন মেনে নগরের ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া। অথচ দেখা যাচ্ছে, শামীমা মোমেন এর অধীনে অনেক প্রকল্পের অনুমোদন ‘বিশেষ সম্পর্ক’ বা ‘সুবিধা’ না পেলে মাসের পর মাস আটকে থাকে।
রাজউকে নকশা জমা দেওয়া এক প্রকৌশলী জানান, নিয়ম মেনে সব কাগজ জমা দিয়েছি। তারপরও তিন মাস ধরে ফাইল আটকে আছে। পরে শুনি ‘উপরের সঙ্গে কথা বলেন।’ সেই ‘উপরের’ মানে ছিল একজন সিন্ডিকেট সদস্য, যিনি টাকা ছাড়া ফাইল আগাবে না বলেই জানিয়ে দেন।”

এই প্রক্রিয়া এতটাই গোপনে চলে যে, কোন ফাইল কোথায় আটকে আছে—তা বুঝতেই পারেন না ভুক্তভোগীরা। আবার কাউকে পছন্দ না হলে বা কেউ প্রতিবাদ করলে, তাঁর ফাইল বছরের পর বছর ধুলায় পড়ে থাকে।

দালালচক্রের সঙ্গে সম্পর্ক
শুধু রাজউকের ভেতরেই নয়, শামীমা মোমেন এর ঘনিষ্ঠ একাধিক দালাল রাজধানীর বিভিন্ন স্থাপনায় ‘ঘুরে বেড়ায়’—যারা নিজেরাই বলেন, ‘আপনার ফাইল আমরা করিয়ে দেব’। এই দালালরা ভবন মালিক, আবাসন ব্যবসায়ী, ঠিকাদার এমনকি সাধারণ আবেদনকারীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, শামীমা মোমেন এর স্বার্থরক্ষায় এই দালালচক্রের একটি অংশ মোবাইল ব্যাংকিং ও নগদ লেনদেনের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে এবং প্রতিদিন রাজউকের বাইরে নির্দিষ্ট কিছু কফিশপে বসে এসব লেনদেন সম্পন্ন হয়।

একজন ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন, “আমি দুদকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলাম। তারপর থেকেই আমার জমির অনুমোদন আটকে আছে। বারবার চেষ্টা করেও কোনো অগ্রগতি হয়নি।”

সুশাসনের দাবিতে কাজ করা বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন বলছে, এসব কর্মকর্তা প্রশাসনের অভ্যন্তরে থাকা দুর্নীতির নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয়েছেন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ ধরনের সিন্ডিকেট শুধু রাজউকের নয়—সমগ্র নগর পরিকল্পনার ভবিষ্যৎ বিপন্ন করে তুলছে। শহরজুড়ে যেসব অননুমোদিত ভবন ও দৃষ্টিকটুভাবে নিয়ম ভেঙে তৈরি স্থাপনা দেখা যায়, তার পেছনে রয়েছে রাজউকের কিছু কর্মকর্তার ‘আনসেনশনড অনুমতি’। আর এই অব্যবস্থার এক বড় নিয়ামক হিসেবে শামীমা মোমেন এর নাম ঘুরেফিরে আসছে।

দুদকের একজন সাবেক কমিশনার বলেন, “দুর্নীতি যদি নিয়মিত চর্চায় পরিণত হয়, তাহলে সিস্টেমই ভেঙে পড়ে। এই সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে দ্রুত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”

রাজউক জনগণের জন্য কাজ করার কথা। অথচ এরই মধ্যে কিছু কর্মকর্তার কারণে প্রতিষ্ঠানটি এখন ‘দালাল ও দুর্নীতির আখড়া’ হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। শামীমা মোমেন এর মতো প্রভাবশালী কর্মকর্তারা যদি প্রতিনিয়ত ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্বার্থ হাসিল করেন, তাহলে সাধারণ নাগরিকদের স্বপ্নের বাসগৃহ কিংবা জমির পরিকল্পনা শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে।


গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন