চাহিদা-সরবরাহের ভারসাম্যহীনতায় শোধনাগারগুলোর লাভ বেড়েছে


বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য এক অস্থির জোয়ার-ভাটার মতো আচরণ করছে—একদিন দাম ঊর্ধ্বমুখী, তো পরদিনই বড় ধরনের পতন। এই দামের ওঠানামা শুধু তেল উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশগুলোর জন্য নয়, বরং ভোক্তা দেশগুলোর অর্থনীতি, জ্বালানি পরিকল্পনা এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাতেও সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
বিশ্বব্যাপী চলমান ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, উৎপাদন সীমাবদ্ধতা ও বাজারে চাহিদা-যোগানের তারতম্যের কারণে এই অস্থিরতা আরও বেড়েছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
কখনো মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা, কখনো ওপেক+ জোটের সিদ্ধান্ত, আবার কখনো বৈশ্বিক মন্দা বা চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য উত্তেজনা-তেলের দামের এই পরিবর্তনশীল গতিপথের পেছনে রয়েছে বহুস্তর বিশ্লেষণ। এমনকি প্রযুক্তি, আবহাওয়া ও রাজনৈতিক পরিবর্তনও দিচ্ছে দামের গ্রাফে বড় ধরনের দোলা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান বিশ্বে অপরিশোধিত তেলের বাজার আর শুধুই সরবরাহ ও চাহিদার গাণিতিক খেলা নয়, এটি এখন ভূরাজনীতি, পরিবেশনীতি এবং বিনিয়োগ বাজারের এক জটিল ছক।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও শোধনাগার খাত সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে আশাজাগানিয়া সাফল্য দেখাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিশ্বজুড়ে বেশ কয়েকটি তেল শোধনাগার বন্ধ হওয়ায় সরবরাহ কমে গেছে, অন্যদিকে গ্রীষ্মকালীন চাহিদা বাড়ায় তৈরি হয়েছে এক ধরনের ঘাটতি, যা তেল শোধনাগারগুলোকে দিয়েছে বিরল এক লাভজনক পরিস্থিতি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি দীর্ঘমেয়াদী নয়, বরং একটি স্বল্পমেয়াদি সুযোগ। তবে এই ‘স্বস্তির হাওয়া’ নিঃসন্দেহে কিছুটা নিঃশ্বাস ফেলতে দিচ্ছে এমন একটি শিল্পকে, যেটি গত কয়েক বছর ধরেই বৈশ্বিক মন্দা, ইভি (ইলেকট্রিক ভেহিকল) বিপ্লব এবং নতুন প্রতিযোগীদের সঙ্গে হিমশিম খাচ্ছিল।
দাম কমলেও চাহিদা ধরে রেখেছে বাজার
মে মাসে অপরিশোধিত তেলের দাম পৌঁছেছে চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে, ওপেক+ জোট প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুত উৎপাদন হ্রাস তুলে নেয়ায় বিশ্ববাজারে সরবরাহ বেড়েছে। তবে চাহিদা এখনো চাঙা। বিশ্বখ্যাত বিশ্লেষণা সংস্থা স্পার্টা কমোডিটিজের নিল ক্রসবির মতে, ‘পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহ এখনো ভারসাম্যহীন। এটাই মার্জিন শক্তিশালী রাখছে।’
তেল শোধনাগারের মার্জিন অর্থাৎ অপরিশোধিত তেলকে পেট্রোল, ডিজেল প্রভৃতি জ্বালানিতে পরিণত করে যা লাভ হয়, তা বর্তমানে ঊর্ধ্বমুখী। মে মাসে বৈশ্বিক গড় শোধনাগার মার্জিন দাঁড়িয়েছে ব্যারেলপ্রতি ৮.৩৭ মার্কিন ডলার যা ২০২৪ সালের মার্চের পর সর্বোচ্চ। যদিও ২০২২ সালের জুনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধপরবর্তী চাহিদায় এ মার্জিন দাঁড়িয়েছিল ৩৩.৫০ ডলার।
বন্ধ হয়ে গেছে একের পর এক শোধনাগার
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে শোধনাগার বন্ধ বা আংশিক বন্ধ হওয়ার ঘটনা মার্জিন বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। ইউরোপে শেল, বিপি এবং পেট্রোইনিয়সের বেশ কিছু শোধনাগার বন্ধ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে লিওন্ডেলবাসেল হিউস্টন রিফাইনারি এই বছর বন্ধ হয়ে গেছে, সামনে আরও দুটি বড় রিফাইনারি-ফিলিপস ৬৬ (লস অ্যাঞ্জেলেস) এবং ভ্যালেরো (বেনিসিয়া)-২০২৫ সালের অক্টোবর ও ২০২৬ সালের এপ্রিলে বন্ধ হতে যাচ্ছে।
এছাড়া আকস্মিক বিদ্যুৎ বিভ্রাট এবং দুর্ঘটনার কারণে অতিরিক্ত উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এপ্রিলের শেষ দিকে আইবেরিয়ান উপদ্বীপে বিদ্যুৎ বিভ্রাটে প্রায় ১৫ লাখ ব্যারেল/দিন ক্ষমতার শোধনাগার বন্ধ হয়ে যায়, যার মধ্যে এখনো ৪ লাখ ব্যারেল/দিন উৎপাদন অনলাইনে আসেনি।
এদিকে নাইজেরিয়ার ড্যাঙ্গোটে এবং মেক্সিকোর ওলমেকা-দুটি নতুন বিশাল প্রকল্প-এপ্রিল মাসে গ্যাসোলিন ইউনিটে অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।
চাহিদা রয়েছে, মজুদ কমেছে
বিশ্বের প্রধান জ্বালানি মজুদ কেন্দ্রগুলোতে মজুদ কমে আসছে। জেপি মরগান বিশ্লেষকদের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ওইসিডি (যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, সিঙ্গাপুরসহ) দেশগুলোর জ্বালানি মজুদ কমেছে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ব্যারেল। ফলে গ্রীষ্মকালীন যাত্রা মৌসুমে যানবাহন ও বিমান চলাচলের বাড়তি চাহিদা মেটাতে শোধনাগারগুলোকে জ্বালানির জোগান আরও বাড়াতে হচ্ছে।
রিস্ট্যাড এনার্জির বিশ্লেষক জানিভ শাহ বলেন, ‘উত্তর গোলার্ধে গ্রীষ্মকালীন চাহিদা বৃদ্ধি মার্জিন ধরে রাখার অন্যতম কারণ।’
মার্কিন শোধনাগার জায়ান্ট ফিলিপস ৬৬ এবং ম্যারাথন পেট্রোলিয়াম বলছে, দেশীয় বাজারে পেট্রোলের চাহিদা ভালো এবং ডিজেল ও জেট ফুয়েলের চাহিদাও গত বছরের তুলনায় বেড়েছে।
ভবিষ্যৎ নিয়ে সতর্কতা
যদিও শোধনাগারগুলো এই মুহূর্তে লাভবান, তবে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিশ্লেষকরা খুব একটা আশাবাদী নন। বাণিজ্য যুদ্ধ, শুল্ক এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ২০২৫ সালের বাকি সময়টিতে তেল চাহিদা বৃদ্ধিকে ধীর করে দিতে পারে।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (আইইএ) পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালের বাকি সময়ের জন্য গড় বৈশ্বিক তেল চাহিদা বৃদ্ধির হার হবে দৈনিক ৬.৫ লাখ ব্যারেল, যেখানে বছরের প্রথম প্রান্তিকে তা ছিল প্রায় ১০ লাখ ব্যারেল।
বিশ্বখ্যাত পরামর্শক সংস্থা উড ম্যাকেঞ্জির অস্টিন লিন বলেন, ‘আমরা মনে করছি, এটি সাময়িক একটা উল্লম্ফন। শোধনাগারগুলোর এখনই উচিৎ হেজিং করে নেয়া-এটাই সম্ভবত তাদের জন্য ‘সেরা সময়’।’
তিন দেশের সরবরাহ সংকটে তেলের বাজার উত্তপ্ত
এদিকে মঙ্গলবার (৩ জুন) বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম আবারও চড়া পথ ধরেছে। এশিয়ার প্রারম্ভিক লেনদেনে ব্রেন্ট ক্রুড ফিউচার্সের দাম ব্যারেলপ্রতি ৫৫ সেন্ট বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫ ডলার ১৮ সেন্টে, যা আগের দিনের তুলনায় ০.৮৫ শতাংশ বেশি। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বেঞ্চমার্ক ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) ৫৯ সেন্ট বা ০.৯৪ শতাংশ লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় ৬৩ ডলার ১১ সেন্টে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় ধরনের তিনটি ঘটনাই বাজারে ঘূর্ণি তুলেছে, ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা। তেহরানের এক শীর্ষ কূটনীতিক জানিয়েছেন, ওয়াশিংটনের নতুন প্রস্তাবটি ‘ইরানের স্বার্থ রক্ষা করছে না’ এবং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে কঠোর অবস্থানই বহাল রেখেছে। আলোচনার সুরাহা না হলে ২০১৮ সালের নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে, ফলে ইরানি তেলের রপ্তানি সীমিতই থেকে যাবে।, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের স্থায়ী অস্থিরতা। যুদ্ধপীড়িত অঞ্চলগুলোর অবকাঠামো ক্ষতি ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা রুশ তেলবাজারের সরবরাহ ঝুঁকি বাড়িয়েছে।, কানাডার আলবার্টায় দাবানল। প্রদেশটির উত্তরাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া দাবানলে কমপক্ষে ৩ লক্ষ ৪৪ হাজার ব্যারেল তেল-স্যান্ডস উৎপাদন দৈনিকভাবে বন্ধ রয়েছে-দেশটির মোট উৎপাদনের প্রায় ৭ শতাংশ।
এর আগে সোমবার (২ জুন) ওপেক ও মিত্র জোট ওপেক-প্লাস জুলাই মাসের জন্য দৈনিক মাত্র ৪ লক্ষ ১১ হাজার ব্যারেল উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানায়-গত দুই মাসের মতোই। বাজারের অনেকেই বড়সড় বাড়তি সরবরাহের ভয় করেছিলেন। সেই আশঙ্কা সত্য না হওয়ায় ‘শেয়ারবাজারে গড়া সব নেতিবাচক অবস্থান বিনিয়োগকারীরা ফটাফট খোলসা করেছেন,’ এক নোটে মন্তব্য করেছেন অস্ট্রেলিয়া-ভিত্তিক এএনজেড ব্যাংকের সিনিয়র কমোডিটি কৌশলবিদ ড্যানিয়েল হাইনস।
বিশ্ববাজারে তেলের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়লেও সরবরাহ ধাক্কা খাওয়ায় আন্তর্জাতিক বিমা ও পরিবহন খরচ আরও চড়া হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নৌপরিবহন বিশ্লেষকরা। অর্থনীতিবিদদের মতে, তেলের ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধি উন্নয়নশীল দেশগুলোর মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে আরও জটিল করে তুলবে।
তবে অনেকেই চোখ রাখছেন ভিয়েনায় আগামী মাসের ওপেক-প্লাস বৈঠকের দিকে। সেখানেই পরিষ্কার হবে, কবে নাগাদ বাড়তি উৎপাদনের গতি বাড়াতে পারে জোটটি-আর তত দিন পর্যন্ত তেলের বাজারে দোলাচল অব্যাহত থাকার সম্ভাবনাই প্রবল।
