শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫
Natun Kagoj
১০ বছরে ১৭ খুন

রূপগঞ্জে সক্রিয় কিশোর গ্যাংয়ের ২১ গ্রুপ

রূপগঞ্জে সক্রিয় কিশোর গ্যাংয়ের ২১ গ্রুপ
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

রূপগঞ্জের সর্বত্র এখন কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য, ২১টি গ্রুপ এখনও সক্রিয় রয়েছে বলে জানা গেছে। এসব গ্রুপের প্রায় সাড়ে ৪শ’ সদস্য গোটা রূপগঞ্জ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। রূপগঞ্জের পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠেছে মাস্তান গ্রুপ। কিশোরদের একটি অংশ এলাকার ‘প্রভাবশালী’ বড় ভাইদের হয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অলিগলি, করছে নানা অপরাধ।

গ্রুপে গ্রুপে দ্বন্দ্ব, খুনোখুনি হচ্ছে, বাড়ছে হানাহানি সংঘাত। দল বেঁধে মাদক সেবন করছে যত্রতত্র। পিছিয়ে নেই ধর্ষণের মতো অপরাধ করতে। বিভিন্ন স্থানে ঘটিত অপরাধকান্ডের তদন্তে বেরিয়ে আসছে উঠতি বয়সী তরুণদের নাম। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। কঠোর হস্তে দমন নীতি নিয়ে এগুচ্ছে তারা। এসব গ্রুপ ভূমি দখল, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে হেন অপকর্ম নেই যা করে না। গত ১০ বছরে কিশোরদের হাতে ১৭ জন খুনের শিকার হয়েছে বলে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে।


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রূপগঞ্জে ২১ টি গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কিং মাস্টার, ডি কোম্পানি, টাইগার গ্যাং, টেনশন গ্যাং, ডেঞ্জার গ্রুপ, সুইচ গ্রুপ, স্যাভেজ গ্রুপ, কুড়াল গ্রুপ, পিনিক গ্যাং, হাতুড়ি গ্যাং, সজীব গ্যাং, আমির গ্যাং, ইভান গ্যাং, পাটানী গ্যাং, আলেক্স গ্রুপ, সেভেন স্টার গ্রুপ, ইয়াং স্টার, ব্লেড গ্যাং, কসাই গ্যাং, লাদেন গ্যাং ও বাবা গ্যাং দাবড়ে বেড়াচ্ছে।


থানা পুলিশ, নিহতের পরিবার ও পত্রপত্রিকা সূত্রে জানা গেছে, রূপগঞ্জে গত ১০ বছরে কিশোরদের হাতে ১৭ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। ২০২৩ সালের ১৩ নভেম্বর ভোলাব পাইস্কা এলাকায় তিন কিশোর বন্ধু মিলে হত্যা করে কিশোর মাওলাকে। একই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর ঘুম ভেঙ্গে দেওয়ায় দাউদপুরের দুয়ারা এলাকায় কিশোর ছোট ভাই জামিল পায়েল হত্যা করে তার বড় ভাই আশরাফুলকে। ২০১৪ সালের ৩ মে চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রের ৩ নং ওয়ার্ডের মাদকাসক্ত কিশোর ছেলে আব্দুল কাদিরের হাতে তার বাবা জাহাঙ্গির আলম হত্যার শিকার হন।

২০২১ সালের ৩ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দেওয়ায় গোলাকান্দাইল বেড়িবাঁধ এলাকায় দুই দল কিশোর গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে সানি (১৭) নিহত হয়েছে। ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল ভুলতা স্কুল এন্ড কলেজের সামনে প্রেম সংক্রান্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই কিশোরের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে সজীব নিহত হয়।

২০২০ সালে কিশোরদের হাতে কায়েতপাড়া এলাকায় আনোয়ার হোসেন ও শিংলাব এলাকায় কিশোর সাইফুল ইসলামের হাতে তার মা দেলোয়ারা বেগম নিহত হন। ২০২২ সালের ১৭ জুন আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চনপাড়া পুনর্বাসন এলাকায় কিশোর দু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে সজল নামে এক কিশোর নিহত হয়। ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি দাউদপুর কাজীরবাগ এলাকায় কিশোর বন্ধুদের হাতে মাহিম খুন হন। ২০১৩ সালের ১১ মে গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের মৃত আমানউল্লার মেয়ে শান্তা মনিকে পিটিয়ে হত্যা করে কিশোর বখাটেরা। সে ভুলতা স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত।

জাঙ্গীর উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাঈম হোসেনকে ২০১৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি গলা কেটে হত্যা করে তার কিশোর বন্ধুরা। একই বছরের ৪ জুন হত্যার শিকার হন মিঠাব এলাকার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী নেয়ামুল হক নাঈম। তাকেও তার কিশোর বন্ধুরা হত্যা করে। ২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর আয়েত আলী উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী প্রিয়াংকা আক্তারকে গলা কেটে হত্যা করে কিশোর বখাটে। ২০১৮ সালের ২১ জানুয়ারি খুনের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র পারভেজ আহম্মেদ জয়।


সূত্র জানায়, ছিনতাই, মাদক কারবার ও বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার পাশাপাশি এলাকায় রাজনৈতিক দলের আধিপত্য বিস্তার করতেও কাজ করে এসব গ্রুপের অনুসারীরা। দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবে এই আশায় স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতারা তাদের মাঝে মধ্যেই কাছে টানেন। রূপগঞ্জে সক্রিয় ২১ কিশোর গ্যাংয়ের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে একই রকম তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিজেদের বড় ও প্রভাবশালী বলে উপস্থাপন করতে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানো, বাইক রাইডিং, অনলাইন ক্যাম্পিং, দেয়াল লিখনের মাধ্যমে গ্যাংগুলো গড়ে উঠছে। এরপর মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, দল বেঁধে মাদকসেবন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, এমনকি মাদক কারবারেও জড়িয়ে পড়ছে এসব গ্রুপ। প্রতিটি দলে ১৩ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে অন্তত ১০-১৫ জন করে থাকছে।

স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করে অপরাধ করতে মহল্লার বড় ভাই এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা এসব দলনেতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। তাঁদের হয়ে বিভিন্ন কর্মসূচিতে এবং দখল ও চাঁদাবাজিতে দল ভারী করে উঠতি বয়সী এই অপরাধীরা। বস্তির দিনমজুর থেকে শুরু করে ধনীর দুলালরা এই চোরাবালিতে নিজের অজান্তেই পা দিচ্ছে।


অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে রূপগঞ্জে বিভিন্ন এলাকায় বখাটে কিশোর ও তরুণরা গড়ে তুলেছে ভয়ংকর 'গ্যাং কালচার'। জানা গেছে, রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি। এ ইউনিয়নে অন্তত ৫টি কিশোর গ্যাং চক্র রয়েছে। এ পুনর্বাসন কেন্দ্রে মাদক, জুয়াসহ সব অপরাধীর আনাগোনা বেশি। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এখানে প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। কিশোর গ্যাংকে কেন্দ্র করে এখানে খুনের ঘটনাও ঘটেছে অতীতে।

মুড়াপাড়ায় রয়েছে ৪টি কিশোর গ্যাং, তারাব পৌরসভায় ৫টি এবং কাঞ্চন পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডে গড়ে উঠেছে অন্তত ৩টি কিশোর গ্যাং চক্র। এছাড়া ভুলতা  ইউনিয়নে ২টি কিশোর গ্যাং চক্র সক্রিয়। গোলাকান্দাইল ইউনিয়নে অন্তত ২টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। কিশোর গ্যাংকে কেন্দ্র করে এ ইউনিয়নে প্রায়ই রক্তপাতের ঘটনা ঘটে। রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নে ৩০০ ফুট সড়ক কেন্দ্রিক নানা অপরাধে জড়াচ্ছে ২টি কিশোর গ্যাং। ভোলাব ইউনিয়নে ২টি এবং দাউদপুর ইউনিয়নে ২টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। কায়েতপাড়া ইউনিয়নে কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয়।


মানবাধিকার, আইন, অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, কিশোর বয়সেই ক্ষমতাধর হয়ে ওঠার প্রবণতা থেকে গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে অনেকে। বড়রা তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে তৈরি করেন। গ্যাংগুলোকে যারা ব্যবহার করছে, তাদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করার পাশাপাশি ওই কিশোরদের সংশোধনেও গুরুত্ব দেন তাঁরা। এই কিশোর গ্যাংয়ের কাছে রয়েছে দেশি অস্ত্রের ছড়াছড়ি, এমনকি অত্যাধুনিক বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র। পারিবারিক বন্ধন ক্রমেই শিথিল হয়ে যাওয়া, সামাজিক অবক্ষয়, অস্থিরতা কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা।


নারায়ণগঞ্জ জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবুল বাশার রুবেল বলেন, কিশোর সংশোধন আইন আছে। কিন্তু যে হারে কিশোর গ্যাং বেড়েছে আরো কঠোর আইন হওয়া দরকার। রূপগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ লিয়াকত হোসেন বলেন, কিশোর গ্যাং অনেকটা কমে গেছে। বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। আরো অভিযান পরিচালনা করা হবে।


রায়হানা/রূপগঞ্জ/সুলতানা
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

আরও পড়ুন