শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫
Natun Kagoj

বাংলা নববর্ষেও বসছে না দুই বাংলার মিলনমেলা: সীমান্তে আক্ষেপ আর অপেক্ষা

বাংলা নববর্ষেও বসছে না দুই বাংলার মিলনমেলা: সীমান্তে আক্ষেপ আর অপেক্ষা
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে পঞ্চগড় সীমান্তে দুই বাংলার ঐতিহ্যবাহী মিলনমেলা এবারও অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ২০১৯ সাল থেকে এই মিলনমেলা বন্ধ রয়েছে এবং ২০২৪ সালে তা পুনরায় শুরু হওয়ার কোনো উদ্যোগ নেই। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ও উভয় দেশের সরকারের নির্দেশনার অভাবে এই ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।

প্রতিবছর বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে পঞ্চগড়ের সীমান্ত এলাকায় এক ব্যতিক্রমধর্মী দৃশ্যের অবতারণা হতো—বাংলাদেশ ও ভারতের সাধারণ মানুষ মিলিত হতেন কাঁটাতারের দুই প্রান্তে। দেখা হতো হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়স্বজনদের সাথে, ভাগ হতো আনন্দ-বেদনার গল্প, আদান-প্রদান হতো উপহারসামগ্রী। তবে করোনার ধাক্কা ও পরবর্তী প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞার কারণে টানা কয়েক বছর ধরে আর বসছে না সেই কাঁটাতারের মিলনমেলা। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।

বাংলা নববর্ষের প্রথম ও দ্বিতীয় দিনে সাধারণত পঞ্চগড়ের অমরখানা, শুকানি, মাগুরমারী, চেংরাবান্ধা, ভজনপুরসহ বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় বসত এই মিলনমেলা। কাঁটাতারের দুই পাশে হাজারো মানুষ ভিড় করতেন আত্মীয়স্বজনের দেখা পেতে। কিন্তু এ বছরও সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও উভয় দেশের সরকারের অনুমতি না থাকায় আয়োজনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে না।

এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর পঞ্চগড়-১৮ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, “নববর্ষ উপলক্ষে সীমান্তে জনসমাগমের একটি রেওয়াজ ছিল। তবে বিভিন্ন কারণে—including করোনা পরবর্তী স্বাস্থ্যঝুঁকি ও নিরাপত্তা—এই মিলনমেলা বন্ধ রয়েছে এবং এখনো নতুন কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি।”

১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এবং ভারতের মধ্যে যে ভৌগোলিক বিভাজন হয়, তা ছিন্ন করে দেয় অনেক আত্মীয়তার সম্পর্ক। কেউ ভারতের জলপাইগুড়ি বা কোচবিহারে থেকে চলে আসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, আবার কেউ এখান থেকে চলে যান ভারতে। এই ভাগাভাগির ফলে পরিবারগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। অনেকেই পরবর্তীতে পাসপোর্ট ও ভিসার মাধ্যমে যোগাযোগ রাখলেও অধিকাংশ দরিদ্র পরিবার সেই সুযোগ পান না।

তাদের জন্যই নববর্ষের দিনটি হয়ে ওঠে এক আশার প্রতীক। বিগত প্রায় এক যুগ ধরে বিজিবি ও বিএসএফ-এর সম্মতিতে সীমান্তের কাঁটাতারের দু’পাশে দাঁড়িয়ে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে কিছু সময় কাটাতে পারতেন তারা। এটি কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, ছিল আবেগ, ছিল সম্পর্কের নতুন বাঁধন।

২০১৯ সালের পর করোনা মহামারির কারণে বন্ধ হয়ে যায় এই ব্যতিক্রমধর্মী মিলনমেলা। এরপর নানা জটিলতা ও প্রশাসনিক অনাগ্রহের কারণে তা আর চালু হয়নি। বিজিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সীমান্তে জনসমাগম যেন না হয়, সেজন্য সর্বসাধারণকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। সীমান্ত এলাকায় বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল মনিরুল ইসলাম বলেন, “আমরা লক্ষ্য করছি, এখনো অনেক সাধারণ মানুষ না জেনে বা আবেগে তাড়িত হয়ে সীমান্তের দিকে ছুটে যান। আমরা তাদের অনুরোধ করছি যেন তারা সীমান্ত আইন লঙ্ঘন না করেন এবং অযথা সীমান্তে ভিড় না করেন।”

এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকায় অপেক্ষারত সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। প্রতিবছর নববর্ষের দিনটি তাদের জীবনে এক ভিন্ন মাত্রা নিয়ে আসত। আত্মীয়-স্বজনদের দেখা, কান্না-মেশানো হাসি, ছোট ছোট উপহার বিনিময়—সব মিলিয়ে এটি ছিল আবেগঘন একটি আয়োজন।

পঞ্চগড় সদর উপজেলার শুকানিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মোজাহার আলী বলেন, “আমার ছোট ভাই ২৫ বছর ধরে ভারতে থাকে। পাসপোর্ট করার সামর্থ্য নেই। একমাত্র এই মিলনমেলাতেই ওকে একবার চোখের দেখা দেখতাম। এবারের নববর্ষেও আর সেই সুযোগ মিলল না।”

পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক সাবেত আলী বলেন, “এই আয়োজন বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমরা কোনো সরকারি নির্দেশনা পাইনি। বিজিবি ও প্রশাসনের যৌথ সমন্বয়ে সীমান্তে যাতে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”

যেখানে দেশের অন্য প্রান্তে নববর্ষ উদযাপন হয় বৈশাখী মেলা, পান্তা-ইলিশ আর সাংস্কৃতিক আয়োজন দিয়ে, সেখানে পঞ্চগড় সীমান্তের মানুষ নববর্ষ উদযাপন করে চোখের জল আর আবেগ দিয়ে। এ যেন মিলনের বদলে বেদনার বৈশাখ। কাঁটাতারের এই বন্ধনে থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন হাজারো আত্মীয়-স্বজন।

কাঁটাতারে আর জড়ো হচ্ছে না মানুষ, নেই সেই আনন্দ, নেই সেই উল্লাস। কিন্তু আত্মীয়দের জন্য ভালোবাসা, অপেক্ষা আর মিলনের আশাটা এখনো ঠিকই কাঁটাতারের ওপার থেকে ডাক পাঠায়। সীমান্তের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা সেই আত্মীয়রা এবারও শুধু দূর থেকে হাত নাড়বেন—হয়তো চোখের জল লুকিয়ে।


নতুন/কাগজ/লাবলু/পঞ্চগড়
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

আরও পড়ুন