শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫
Natun Kagoj

গাজায় মার্কিন সমর্থিত গোষ্ঠীর ত্রাণ বিতরণে, ভিড়-বিশৃঙ্খলা 

গাজায় মার্কিন সমর্থিত গোষ্ঠীর ত্রাণ বিতরণে, ভিড়-বিশৃঙ্খলা 
কেরেম শালোম সীমান্তে গাজার পাশে ৪০০টির বেশি ট্রাক মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতিসংঘের বিতরণের অপেক্ষায় ছিল। ছবি: বিবিসি নিউজ বাংলা।
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

গাজায় মার্কিন ও ইসরায়েল সমর্থিত একটি বিতর্কিত গোষ্ঠীর নতুন ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি ভিড় জমিয়েছেন। 

কেন্দ্রটি কাজ শুরু করার একদিনের মাথায় এমন ঘটনা ঘটে । বিবিসি নিউজ বাংলার এক প্রতিবেদনে ২৮ মে বুধবার সকালে এ তথ্য জানিয়েছে।

ভিডিওতে দেখা গেছে, রাফাহ শহরের গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন বা জিএইচএফ কম্পাউন্ডে  লোকজন কাঁটাতারের বেড়া ও মাটির বাঁধ ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ছে।

জিএইচএফ জানিয়েছে, এক পর্যায়ে ত্রাণ প্রত্যাশীদের তুলনায় বিতরণ কর্মীদের অনেক কম হওয়ায় তাদের দলকে পিছু হটতে হয়। ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী জানিয়েছে, এ ভিড় সামলাতে তাদেরকে ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে হয়েছে।

জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে জিএইচএফ নামক এ ত্রাণ বিতরণ সংস্থাটি সশস্ত্র মার্কিন নিরাপত্তা কর্মী ব্যবহার করে গাজায় ত্রাণ সরবরাহের চেষ্টা করছে।

 ইসরায়েলি অবরোধের কারণে ১১ সপ্তাহ ধরে গাঁজায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে, অবরোধ শিথিল হয়েছে।

গাজায় ওই ত্রাণ বিতরণের ভিডিওগুলো দেখে জাতিসংঘের ভাষ্য,পর্যাপ্ত ত্রাণ সরবরাহের জন্য ২১ লাখ মানুষের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করে রেখেছে। 

জিএইচএফর এ কার্যক্রমে সহযোগিতা করতে জাতিসংঘসহ অন্যান্য খাদ্য সংস্থা অস্বীকৃতি জানায়।

জাতিসংঘের একজনের ভাষ্য, এ উদ্যোগ মানবিক নীতিমালা লঙ্ঘন করে এবং ত্রাণকে রাজনৈতিক ও সামরিক লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ঝুঁকি তৈরি করে। এ ত্রাণ কার্যক্রম শারীরিকভাবে দুর্বলদের পিছে ঠেলে দেবে এবং সাথে মানুষকে বাস্তুচ্যুত করবে, বিপদের মুখে ফেলবে এবং বৈশ্বিকভাবে ত্রাণ বিতরণের জন্য একটি খারাপ নজির তৈরি করবে।

ইসরায়েলের একজনের ভাষ্য, হামাস যাতে ত্রাণ চুরি না করতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতেই বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। 

এদিকে, ইসরায়েলের এ চুরির অভিযোগ অস্বীকার করেছে হামাস। 

এর আগে, জিএইচএফ সোমবার ঘোষণা দিয়ে বলে, গাজায় কার্যক্রম শুরু করেছে এবং বিতরণ কেন্দ্রগুলো থেকে ফিলিস্তিনিদের ত্রাণ দেয়া হয়।

 ইসরায়েলি সেনাবাহিনী মঙ্গলবার বিকেলে জানায়, রাফার তাল আল-সুলতান এলাকায় এবং মোরাগ করিডোরে দুইটি বিতরণ কেন্দ্র থেকে খাদ্য বিতরণ শুরু হয়েছে।

প্রায় একই সময়ে, ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি গণমাধ্যমে তাল আল-সুলতান কেন্দ্রে ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ সারির শেয়ার করে। এক ঘণ্টা পর দেখা যায়, হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুরা কম্পাউন্ডে ঢুকে পড়েছে। এক ভিডিওতে লোকজনকে দৌড়াতে ও নিচু হয়ে পড়তে দেখা যায়, পেছনে গুলির শব্দ শোনা যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন ভাষ্য, লোকজন বিতরণ এলাকা থেকে খাদ্য ও অন্যান্য ত্রাণ লুটপাট করে নিচ্ছিল। আশপাশে অবস্থান নেয়া ইসরায়েলি সেনারাও গুলি ছুড়েছে।

বিবিসি আরবিকে সেখানকার এক ব্যক্তি বলেন, "অবস্থা খুবই কঠিন ছিল। প্রতি দফায় মাত্র ৫০ জনকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল। শেষে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তখন মানুষ গেট টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ে, অন্যদের মারধর করে এবং সব ত্রাণ নিয়ে যায়।"

তিনি আরও বলেন, "এটা ছিল এক লজ্জাজনক অভিজ্ঞতা। আমরা প্রচণ্ড ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছি। এক কাপ চা খাওয়ার জন্য একটু চিনি আর একটা রুটি চাচ্ছি মাত্র।"

এক নারী বলেন,"ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মানুষকে চরম পর্যায়ে নিয়ে গেছে। মানুষ এতটাই ক্লান্ত যে, শুধু সন্তানদের খাওয়াতে তারা জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে প্রস্তুত।"

জিএইচএফ জানিয়েছে, স্থানীয় এনজিওর সহযোগিতায় এখন পর্যন্ত আট হাজার খাদ্যের প্যাকেট বিতরণ করেছে। যা দিয়ে প্রায় ৪ লাখ ৬২ হাজার মানুষ খেতে পারবে। 

 জিএইচএফ এ কার্যক্রমে হামাসের বিরুদ্ধে বাধা দেয়ার অভিযোগ করেছে। তারা এ দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি।

জিএইচএফ এক বিবৃতিতে বলেছে, শেষ বিকেলের দিকে এক সময় ত্রাণ প্রত্যাশীর সংখ্যা বাড়লে তাদের দলটি কিছুটা পিছু হটে যাতে সবাই নিরাপদে ত্রাণ নিতে পারে এবং হতাহত এড়ানো যায়। কিছুক্ষণ পরে স্বাভাবিক কার্যক্রম আবার শুরু হয়।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী একজন বলে, তারা কমাউন্ডের বাইরে সতর্কতামূলক ফাঁকা গুলি ছুঁড়েছে।

গাজায় হামাস পরিচালিত মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, ইসরায়েলের ত্রাণ বিতরণ উদ্যোগ 'ব্যর্থ হয়েছে'।

নিউইয়র্কে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেন,আমরা গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন কর্তৃক স্থাপিত একটি বিতরণ কেন্দ্রের আশেপাশে গাজা থেকে বেরিয়ে আসা ভিডিওটি দেখছি। সত্যি বলতে, এ ভিডিওগুলি, এ ছবিগুলি হৃদয়বিদারক। 

জাতিসংঘের সমালোচনাকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেন, 'চরম ভণ্ডামি', আমার মনে হয়,অধিকাংশ মানুষ একমত হবেন যে এটা ইতিবাচক খবর। মূল কথা হচ্ছে গাজায় ত্রাণ যাচ্ছে। 

জিএইচএফ জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে দক্ষিণ ও মধ্য গাজায় চারটি বিতরণ কেন্দ্র খুলবে। যেখানে ফিলিস্তিনিরা খাদ্য ও অন্যান্য ত্রাণ সংগ্রহ করতে পারবে। এ সপ্তাহের শেষ নাগাদ তারা ১০ লাখ মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দিতে চায়।

মার্কিন নিরাপত্তা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এ ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে ইসরায়েলি সেনারা চারপাশে পাহারা দেবে। ফিলিস্তিনিদের সেখানে প্রবেশের আগে পরিচয় যাচাই ও হামাস সম্পৃক্ততা যাচাই করা হবে।

তবে জাতিসংঘ ও অন্যান্য ত্রাণ সংস্থাগুলো বলেছে, তারা এমন কোনো পরিকল্পনায় অংশ নেবে না- যা মানবতা, স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার মৌলিক নীতিগুলোকে লঙ্ঘন করে।

ইসরায়েল ২রা মার্চ গাজায় মানবিক সাহায্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়। দুই সপ্তাহ পর সামরিক অভিযান শুরু করে দুই মাসের যুদ্ধবিরতি ভেঙে গাজায় জিম্মি থাকা ৫৮ জনকে মুক্ত করা। ইসরায়েলি বাহিনী গাজাজুড়ে ১৯শে মে নতুন অভিযান শুরু করে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু জানিয়েছিলেন তারা গাজার পুরো নিয়ন্ত্রণ নেবে।

দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে এবং মার্কিন মিত্রদের চাপে তারা ইসরায়েল ত্রাণ প্রবেশে অবরোধ কিছুটা শিথিল করে এবং সীমিত আকারে ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেয়।

পরে ইসরায়েল জানায়, তারা অন্তত ৬৬৫টি ট্রাক ত্রাণ, যেমন ময়দা, শিশুখাদ্য ও ওষুধ গাজায় প্রবেশ করতে দিয়েছে।

 কেরেম শালোম সীমান্তে গাজার পাশে ৪০০টির বেশি ট্রাক মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতিসংঘের বিতরণের অপেক্ষায় ছিল।

জাতিসংঘ তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্য না করলেও তারা আগে জানিয়েছিল, নিরাপত্তাহীনতা, লুটপাটের ঝুঁকি এবং ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় জটিলতার কারণে ত্রাণ সংগ্রহে বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

জাতিসংঘে রোববার বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক প্রধান সিন্ডি ম্যাককেই বলেন, বর্তমানে যত ত্রাণ যাচ্ছে তা "সাগরে এক ফোঁটা" মাত্র এবং গাজায় খাদ্য সংকট ও দামের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে এই ত্রাণ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট নয়।  


দৈএনকে/ মেলোরী
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন