খাতুনগঞ্জে গরম মসলার ঝাঁজ এখন কিছুটা কম


কোরবানির ঈদ সামনে রেখে খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজার সরগরম। দেশের ভোগ্যপণ্যের দ্বিতীয় বৃহৎ এ পাইকারি বাজারে গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় সব ধরনের মসলার দামই কম। এলাচের বাজার একটু চড়া।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বৈধ পথ বাদ দিয়ে ভারতসহ আশপাশের দেশ থেকে অবৈধভাবে মসলা আসার কারণে বিগত বছরগুলোর চেয়ে এবার মসলার দাম কম। পাশাপাশি ৫ আগস্ট পরবর্তী নতুন নতুন আমদানিকারক বাজারে আসায় আমদানি বাড়ার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাজারে।
লবঙ্গ, এলাচ, দারুচিনিসহ কোরবানিতে বিভিন্ন মসলার চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। এতে খুচরা থেকে পাইকারি পুরো বাজারই গরম থাকে। তবে এবারের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। এলাচ ছাড়া অন্য প্রায় সব মসলার দাম গত বছরের তুলনায় কম।
খাতুনগঞ্জের ইলিয়াছ মার্কেট ও জাফর মার্কেট ঘিরে মসলার পাইকারি বাজার। সেখানকার মসলা ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে চাহিদার গরম মসলার ৯০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। সাফটা চুক্তির সুযোগ নিয়ে ভারত হয়েও অনেক মসলা আসে বাংলাদেশে। পরিমাণে কম হলেও সাধারণভাবে ব্যবহৃত মসলার মধ্যে এলাচের দাম সর্বাধিক।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি এলাচ আমদানি হয় গুয়েতেমালা থেকে। ভারত হয়েও কিছু এলাচ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসে। চায়না ও ভিয়েতনাম থেকে দারুচিনি আমদানি হয়। লবঙ্গ আমদানি হয় ইন্দোনেশিয়া থেকে। বিগত কয়েক বছর মাদাগাস্কার থেকেও কিছু লবঙ্গ আমদানি হচ্ছে।
মরিচ, হলুদ, ধনিয়ার পর মাংসসহ রান্নায় চিকন জিরার চাহিদা বেশি। ভারত, আফগানিস্তান, সিরিয়া, চায়না থেকে চিকন জিরা আমদানি হয়। চলতি বছর আফগানিস্তান থেকে বেশি জিরা আমদানি হয়েছে। পাশাপাশি মিষ্টি জিরা আসে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে।
গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় সব ধরনের মসলার দাম কমেছে। ৫ আগস্ট পরবর্তীসময়ে নতুন নতুন আমদানিকারক মসলা আমদানি করেছেন। এতে আমদানি বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে বাজারে। তাছাড়া ভারত থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়েও মসলা ঢুকছে। এতে বৈধ আমদানির চেয়ে সীমান্ত দিয়ে আসা মসলার দাম কম পড়ছে।
সরেজমিনে খাতুনগঞ্জে গিয়ে দেখা যায়, কোরবানির ঈদ সামনে রেখে পাইকারি বাজারটিতে গরম মসলার বেচাকেনা বেড়েছে। মসলা ব্যবসায়ীরা বলছেন, খাতুনগঞ্জের মসলার বাজারে এলাচের দাম নিয়ন্ত্রিত হয় অব্যবসায়ীদের হাতে। যারা ডিও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কাগুজে কেনাবেচার মাধ্যমে এলাচের বাজার অস্থির করে রাখেন।
ব্যবসায়ীরা বলেন, মানভেদে বাজারে কয়েক স্তরের এলাচ রয়েছে। এবছর গত বছরের চেয়ে সব এলাচের দাম কেজিতে এক হাজার টাকা বেশি। বাজারে বর্তমানে ভালো মানের ‘আরএস-জাম্বো’ এলাচ কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে চার হাজার ৭শ টাকায়। এক মাস আগেও পাঁচ হাজার টাকা ছিল এসব এলাচ। গত বছর একই সময়ে এসব এলাচ বিক্রি হয়েছিল তিন হাজার ৭শ টাকায়। একইভাবে মধ্যম মানের ‘এলএমজি’ এলাচ বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি চার হাজার টাকায়। গত বছর ছিল প্রতি কেজি তিন হাজার টাকা। অপেক্ষাকৃত কম মানের ‘এমওয়াইকিউ’ এলাচ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি তিন হাজার ৭শ টাকা। গত বছর এসব এলাচের দাম ছিল দুই হাজার ৭শ টাকা।
খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে আজ লবঙ্গ বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ১২শ ৫০ টাকায়। গত বছর এসব লবঙ্গ বিক্রি হয়েছিল ১৩শ থেকে ১৩শ ৫০ টাকা। বাজারে দুইভাবে দারুচিনি বিক্রি হয়। চায়না থেকে আসা দারুচিনি ২৫ কেজি বস্তা আকারে পাওয়া যায়। এসব দারুচিনি প্রতি কেজি ৩৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছর এসব দারুচিনি ৪০৫ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। তবে ভিয়েতনাম থেকে আসা দারুচিনির দাম গত বছরের চেয়ে বেশি। এসব দারুচিনি ১০ কেজির প্যাকেটে বিক্রি হয়। বর্তমানে ভিয়েতনাম থেকে আমদানি হওয়া দারুচিনি ৪৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। গত বছর এসব দারুচিনির দাম কেজিতে ২৫ টাকার মতো কম ছিল।
ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে আফগানিস্তান ও ভারতের চিকন জিরা বাজারে রয়েছে। আফগানিস্তান থেকে আসা জিরা কেজি ৬১০ টাকা এবং ভারতের চিকন জিরা ৬শ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গত বছর এসব জিরার দাম কেজিতে দুইশ টাকা বেশি ছিল। গত বছর মিষ্টি জিরা কেজি ২৫০ টাকা করে কেনাবেচা হলেও এবার বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়।
মসলা হিসেবে জয়ত্রী, জায়ফলের চাহিদাও রয়েছে। জয়ত্রী ইন্দোনেশিয়া থেকে এবং জায়ফল শ্রীলঙ্কা ও ভারত থেকে আমদানি হয়। বাজারে জয়ত্রীর দাম গত বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি। বর্তমানে ২৭শ টাকা কেজি দরে জয়ত্রী কেনাবেচা হচ্ছে। অন্যদিকে জায়ফলের দাম গত বছরের চেয়ে কম। গত বছর জায়ফল বিক্রি হয়েছিল প্রতি কেজি ৬৫০ টাকা। এবার বিক্রি হচ্ছে ৫৬০ টাকা।
এবার মরিচ, হলুদ, ধনিয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের মসলার সরবরাহ বেশি। বাজারে দামও কম। বিশেষ করে এবার ডলারের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার কারণে আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খুলতে আমদানিকারকদের বেগ পেতে হয়নি। এতে মসলার স্বাভাবিক আমদানি হয়েছে। যার প্রভাব রয়েছে বাজারে।
গরম মসলা ব্যবসায়ী মো. আলমগীর নতুন কাগজ কে বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় সব ধরনের মসলার দাম কমেছে। ৫ আগস্ট পরবর্তীসময়ে নতুন নতুন আমদানিকারক মসলা আমদানি করেছেন। এতে আমদানি বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে বাজারে। তাছাড়া ভারত থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়েও মসলা ঢুকছে। এতে বৈধ আমদানির চেয়ে সীমান্ত দিয়ে আসা মসলার দাম কম পড়ছে। যে কারণে দামও কমেছে।
রান্নায় অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ মরিচ। চট্টগ্রামে স্থানীয় মিষ্টি জাতের মরিচ বাদেও মধ্যম ঝাল থেকে কড়া ঝালের মরিচও বিক্রি হয়। এবছর মরিচের দামও এক তৃতীয়াংশ কম। গত বছর সব ধরনের মরিচ ৩৭০ থেকে ৪শ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। এবার এসব মরিচ ১৪০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে হাটহাজারীসহ চট্টগ্রামের স্থানীয় মরিচ বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা কেজিতে, নোয়াখালীর মধ্যম ঝালের মরিচ ১৪০ থেকে ১৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। কুমিল্লার কড়া ঝাল মরিচ বিক্রি হচ্ছে ১৭০-১৮০ টাকা কেজিতে।
এবার ধনিয়ার দামও কমেছে। বাজারে দেশি ফরিদপুর জাতের ধনিয়া বেশি ব্যবহৃত হয়। মোটা দানার কারণে ফরিদপুরের ধনিয়ার ব্যবহার বেশি বলে জানান ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে পাইকারি বাজারে মানভেদে ১৩০ থেকে ২শ টাকা কেজিতে ধনিয়া বিক্রি হচ্ছে। গত বছর এসব ধনিয়া কেজিতে ৫০ টাকা বেশি ছিল।
বাজারে দেশি জাতের পাশাপাশি ভারতীয় হলুদ বিক্রি হচ্ছে। তবে দেশি জাতের হলুদের মান ভালো বলে জানান ব্যবসায়ীরা। এবার সব ধরনের হলুদ কেজিপ্রতি ২১০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছরের চেয়ে ১০-২০ টাকার মতো কম।
খাতুনগঞ্জের মসলা ব্যবসায়ী মেসার্স হাজি ইসহাক সওদাগরের স্বত্বাধিকারী মো. সেকান্দার নতুন কাগজ কে বলেন, ‘এবার মরিচ, হলুদ, ধনিয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের মসলার সরবরাহ বেশি। বাজারে দামও কম। বিশেষ করে এবার ডলারের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার কারণে আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খুলতে আমদানিকারকদের বেগ পেতে হয়নি। এতে মসলার স্বাভাবিক আমদানি হয়েছে। যার প্রভাব রয়েছে বাজারে। তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেচাকেনা তুলনামূলক কম।’
রাষ্ট্রীয় ভোগ্যপণ্য বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, খুচরা বাজারে দেশি মরিচ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২৩০-৩৩০ টাকা, গত বছর বিক্রি হয়েছিল ৩৫০ থেকে ৪৪০ টাকায়। খুচরায় দেশি হলুদ বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৪শ টাকায়, গত বছর এসব হলুদ বিক্রি হয়েছিল ৩১০ টাকা থেকে ৪শ টাকা কেজিতে। জিরা বিক্রি হচ্ছে ৬৩০ টাকা থেকে ৭৫০ টাকা কেজিতে। একবছর আগেও এসব জিরা বিক্রি হয়েছিল ৬৫০ টাকা থেকে ৮শ টাকায়।
বাজারে খুচরায় লবঙ্গ বিক্রি হচ্ছে ১৩শ ৬০ টাকা থেকে ১৬শ টাকা। গত বছর এসব লবঙ্গ বিক্রি হয়েছিল ২০০-২৮০ টাকায়। এবার এলাচ বিক্রি হচ্ছে ৪৫শ থেকে ৫৫শ টাকায়। এক বছর আগে এসব এলাচের দাম ছিল ৩ হাজার থেকে ৩৮শ টাকা। তবে খুচরা বাজারে দারুচিনির দাম গত বছরের মতো অপরিবর্তিত বলে জানিয়েছে টিসিবি। বাজারে দারুচিনি বিক্রি হচ্ছে ৫শ থেকে ৬শ টাকা কেজিতে।
