পুরান ঢাকায় হরেক রকম ইফতারে জমজমাট রমজানের ইফতার বাজার


রমজান মাস এলেই রাজধানীর ইফতার বাজারগুলো জমজমাট হয়ে ওঠে সুস্বাদু ও মুখরোচক বিভিন্ন খাবারে। পুরান ঢাকার চকবাজারের ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা লইয়া যায়’ থেকে শুরু করে বেইলি রোডের নবাবী শাহী হালিম, ঘি ও জাফরানে ভাজা নবাবী স্পেশাল শাহী জিলাপি, নবাবী জর্দা, নবাবী ক্ষিরসা ফালুদা, নবাবী জাফরানি পেস্তা বাদাম শরবত, নবাবী বোরহানিসহ নানা আইটেম। এছাড়া নিউ মার্কেট, গাউসিয়া, হাতিরপুলসহ এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় প্রচলিত ইফতারির পাশাপাশি নানা স্বাদের বাহারি ইফতার সাজিয়ে হাঁকডাক দিতে দেখা যায় মৌসুমি ব্যবসায়ীদের। পাশাপাশি হোটেল আর রেস্টুরেন্টের সামনেও বিশেষ আয়োজনে বিক্রি করা হয় লোভনীয় নানা পদের ইতফারসামগ্রী।
রমজানের প্রথম দিন থেকেই এসব বাজার শুরু হলেও গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন ইফতার বাজার ঘুরে বেশ জমজমাট দেখা গেছে এসব বাহারী ইফতার বাজারের।
দেখা যায়, দুপুরের পর থেকেই বাহারি ইফতারসামগ্রী নিয়ে দোকান খুলতে শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। তবে বেশিরভাগ ক্রেতাদের চোখে পরে বিকেল থেকে। আর ইফতারের আগ মুহূর্তে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়েন তারা। প্রচলিত ইফতারির পাশাপাশি নানান স্বাদের বাহারি আয়োজনের ইফতার কিনতে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভীড়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় একই চিত্র।
চকবাজারে বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা লইয়া যায়Ñ নামের বিশেষ ইফতারি কিনতে ক্রেতাদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে দেখা যায়। সেই সাথে মোবাইল ফোনে ছবি তুলা আর সেলফিতে ব্যাস্ত বিভিন্ন বয়সের মানুষ সহ জেন-জি’রা। এই ইফতারি তৈরিতে মাংস, সুতি কাবাব, মাংসের কিমা, ডাবলি, বুটের ডাল, ডিম, মগজ, আলু, ঘি, কাঁচা ও শুকনা মরিচসহ নানা পদের খাবার আইটেম এবং হরেক ধরনের মসলার ব্যবহার হয়। প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৪০০ থেকে ৪৮০ টাকা দরে। জানা যায়, ১৯৪৫ সালের দিকে শাহী জামে মসজিদ চত্বরে বাণিজ্যকভাবে এ খাবার বিক্রি শুরু করেন জনৈক ব্যক্তি। সেই খাবারটি এখন পুরান ঢাকাসহ গোটা রাজধানীতে একটি আকর্ষণীয় ইফতারির আইটেম হিসেবে পরিচিত।
ইফতার কিনতে এসে আলী আরাফাত নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, পরিবারের সবার জন্য এবার পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক ইফতার বাজার থেকে ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা লইয়া যায়’ নিতে এসেছি। এখানে অনেক মানুষের ভীড় দেখে ভালোই লাগছে।
রাজধানীর বেইলি রোডেও দেখা যায় ক্রেতাদের ভিড়। ইফতারসামগ্রীর মধ্যে নবাবী শাহী হালিম, ঘি ও জাফরানে ভাজা নবাবী স্পেশাল শাহী জিলাপি, নবাবী জর্দা, নবাবী ক্ষিরসা ফালুদা, নবাবী জাফরানি পেস্তা বাদাম শরবত, নবাবী বোরহানিসহ নানা আইটেম। ইফতার কিনতে এসে আঁখি মীর বলেন, বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছি বেইলি রোডে নানা রকমের ইফতারি পাওয়া যায়। আজ ৫ম রোজায় সব বান্ধবীদের সাথে নিয়ে ইফতার করবো। তাই এখানে এসেছি ইফতারি কেনার জন্য।
এদিকে ঢাকা শহরজুড়ে অলি-গলি, রাস্তার পাশের ইফতারসামগ্রী থেকে রেস্তোরাঁর ইফতার সামগ্রীর দামের রয়েছে বিস্তর ফারাক। যেখানে রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে পাঁচ থেকে ১০ টাকায় ইফতার সামগ্রী পাওয়া যায় আর সেখানে রোস্তোরাঁ গুলো বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ২০ টাকা করে।
আরমান নামে একজন কলেজ শিক্ষার্থী বলেন, রাস্তার পাশের দোকান গুলো থেকে অভিজাত রেস্তোরাঁ গুলো প্রায় সব কিছুতেই ডাবল দামে ইফতার সামগ্রী বিক্রয় করছে। তারা প্রতি পিস ডিম চপ ৩০ টাকা, ভেজিটেবল টোস ৪০ টাকা, চিকেন টোস ৫০ টাকা, ভেজিটেবল রোল ৪০ টাকা, চিকেন রোল ৫০ টাকা নিচ্ছেন। এছাড়া সব টিক্কা বিক্রি করছে পিসপ্রতি ৫০ টাকা করে।
এবারের রমজানে সব শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে খেজুরের দাম। খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু ইসলামেও যেমন আলাদা গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি গুণগত মানের কারণে তাৎক্ষণিক শক্তি জোগান দানে খেজুর অতুলনীয় একটি খাদ্যদ্রব্য।
দেশীয় বাজারে বহু জাতের খেজুরের মধ্যে চাহিদার শীর্ষে রয়েছে ইরাকি জায়েদি খেজুর। এ ছাড়া নিম্নবিত্তের ভরসা হিসেবে রয়েছে নরম বরই জাতের খেজুর। গেলো বছরের তুলনায় নরম বরই খেজুর ৩০ থেকে ৪০ টাকা কমে কেজিতে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা, জায়েদি খেজুর কেজি ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা কমে ৩৫০ থেকে ৩৭০ টাকা, আজোয়া খেজুর কেজিতে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কমে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা, মেডজল খেজুর কেজিতে ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা কমে ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা এবং মাবরুম খেজুর কেজিতে ৪০০ টাকা কমে এক হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে বহুল চাহিদা থাকা জায়েদি খেজুর পাইকারিতে ১০ কেজি কার্টনের দাম এক হাজার ৭০০ টাকা থেকে এক হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বস্তার খেজুর ১২৫ টাকা থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এবার খেজুরের আমদানি বেশি থাকায় জায়েদি খেজুরের দাম আরো কমে আসতে পারে বলে ধারণা করছেন ব্যবসায়ীরা।
জানা যায়, ছোট ব্যবসায়ীদের কাছে ঋণপত্র খোলার মার্জিনসহ বিভিন্ন শর্ত শিথিলের কারণে ও ডিউটি মূল্য কমানোর কারণে আমদানিকারকরা এবার প্রচুর খেজুর আমদানি করেছে। গত বছর ডিউটিসহ বিভিন্ন জটিলতার কারণে তারা আমদানির সুযোগ পায়নি। বাজারে এমন অবস্থা চলমান থাকলে খেজুরের দাম ও সরবরাহ অনেক সহজ হবে। দীর্ঘদিনের চলমান বাজার ব্যবস্থার জন্য রমাজানে খেজুর নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে অস্বস্তিকর অবস্থা ছিল। আমদানি বৃদ্ধি ও সুবিধার জন্য এ বছর খেজুরের দাম ও সরবরাহ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। বন্দর ও জাহাজে আরো ৩০ শতাংশের মতো খেজুর আছে। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই লাভজনক অবস্থায় থাকবে বলেও জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, গত বাজারে হাজী সেলিমের মদিনা ও নজরুল ইসলামের নাসা সিন্ডিকেট করে একচেটিয়া খেজুর আমদানি করে সেগুলো সংরক্ষণ করে, শোরুম খুলে খেজুর বিক্রি করেছে। বাজারে খেজুরের সঙ্কট ও দাম বেড়েছে। ঋণপত্র খোলার মার্জিনসহ বিভিন্ন শর্ত শিথিলের কারণে এবার ছোট ছোট আমদানিকারকরা ব্যবসা করার সুযোগ পেয়েছেন। তাই রমজানের বাজার নিয়ে ক্রেতাদের দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে না।
