স্ক্যাবিস সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ


যে কারণে দেশে স্ক্যাবিস সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্ক্যাবিসের লক্ষণ সাধারণত সংক্রমণের ২ থেকে ৬ সপ্তাহ পর দেখা দেয়।
ত্বকের একটি ছোঁয়াচে রোগ স্ক্যাবিস। পরিবারের একজন আক্রান্ত হলে, অন্যদের মধ্যেও এটি দ্রুত সংক্রমিত হতে পারে। ছোঁয়াচে হলেও স্ক্যাবিস প্রাণঘাতী রোগ নয়।
বাংলাদেশে স্ক্যাবিসের ব্যাপক বিস্তারের পেছনে প্রধানত দারিদ্র্য, ঘনবসতি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং জনসচেতনতার অভাবকে দায়ী করা যায়। দেশের বস্তি এলাকা, গ্রামীণ অঞ্চল এবং রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় এই রোগের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি। যেখানে ঘনবসতি, স্যানিটেশন ব্যবস্থার অভাব এবং স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা বিদ্যমান।
বন্যা পরবর্তী সময়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, পরিষ্কার পানির অভাব, সাধারণ সাবানের অপ্রাপ্যতা এবং স্ক্যাবিস সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাব এই রোগের বিস্তারকে ত্বরান্বিত করে। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা নেয় না বলে পরিবারের অন্য সদস্যরাও দ্রুত সংক্রমিত হয়, যা রোগ নিয়ন্ত্রণকে আরও জটিল করে তোলে।
২০২২ সলের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, স্ক্যাবিস একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যেখানে প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়। উষ্ণমণ্ডলীয় ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই রোগের হার সবচেয়ে বেশি, বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ মানুষ, ল্যাটিন আমেরিকার কিছু অঞ্চলে ১০ থেকে ২০ শতাংশ শিশু এবং আফ্রিকার উপ-সাহারা অঞ্চলে ৫ থেকে ১০ শতাংশ মানুষ স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হয়।
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই রোগের ব্যাপক সংক্রমণ দেখা যায়, যেখানে ভারতে বছরে প্রায় ২ দশমিক ৫ কোটি এবং বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৫০ লাখ মানুষ স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে শিশুরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। গ্রামীণ এলাকায় (৮ থেকে ১২ শতাংশ) শহরাঞ্চলের (৫ থেকে ৮ শতাংশ) তুলনায় সংক্রমণের হার বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এই রোগটি আগে দেখা গেলেও মাঝে অনেক কমে গিয়েছিল। এই রোগটির বর্তমান বিস্তার হয়েছে প্রধানত টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে। ২০২৩ সালের মে মাসে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে, প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ স্ক্যাবিসে আক্রান্ত, কিছু শিবিরে এই হার ৭০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে।
২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে স্ক্যাবিস প্রতিরোধে ওষুধ বিতরণ করে। ঢাকার মাদ্রাসাগুলোয় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় ৩৪ শতাংশ শিশু স্ক্যাবিসে আক্রান্ত, যেখানে পুরুষ শিশুদের মধ্যে এই হার ৩৯ দশমিক ৪ শতাংশ এবং মেয়ে শিশুদের মধ্যে ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ।
যে কারণে স্ক্যাবিস হয়
স্ক্যাবিস হল সারকোপ্টেস স্ক্যাবি ‘Sarcoptes scabiei’ নামক এক ধরনের অণুবীক্ষণিক মাইট বা পোকা, যা মানুষের ত্বকে পরজীবী হিসেবে অবস্থান করতে পারে ও ত্বকের বিভিন্ন স্থানে চুলকানি এবং ফুসকুড়ি সৃষ্টি করতে পারে। এই পরজীবী মানব ত্বকের ওপরের স্তরে (Stratum corneum) বাসা বেঁধে ডিম পেড়ে বংশবিস্তার করে, ফলে তীব্র চুলকানি, লাল ফুসকুড়ি এবং ছোট ছোট ফোসকার সৃষ্টি হয়।
এই অনুবিক্ষনীক মাইট বা পোকা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মুখমণ্ডল ও মাথার ত্বকে স্থির ভাবে থাকতে পারে না, তাই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মুখমণ্ডল ও মাথার ত্বক ছাড়া সারা শরীরের ত্বকে চুলকানি এবং ফুসকুড়ি সৃষ্টি করতে পারে, তবে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মুখমণ্ডল ও মাথার ত্বকেও চুলকানি এবং ফুসকুড়ি হতে পারে।
লক্ষণ
স্ক্যাবিসের লক্ষণ সাধারণত সংক্রমণের ২ থেকে ৬ সপ্তাহ পর দেখা দেয়। তবে যারা আগে কখনো স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হয়নি, তাদের ক্ষেত্রে লক্ষণ দেরিতে প্রকাশ পেতে পারে। স্ক্যাবিসের প্রধান লক্ষণ গুলো হলো:
শরীরে তীব্র চুলকানি, বিশেষ করে রাতের বেলা।
ত্বকে লাল ফুসকুড়ি বা দানা (হাতের আঙুলের মাঝের ত্বকে, কব্জি, কোমর, নাভির চারপাশের ত্বকে, বগল, যৌনাঙ্গের ত্বকে বেশি দেখা যায়) (শিশু ও নবজাতকদের ক্ষেত্রে মুখ, গলার, ত্বকেও দেখা দিতে পারে)।
ত্বকের উপর ছোট ছোট সুড়ঙ্গের মতো দাগ (মাইট ত্বকের নিচে গর্ত করে বলে এমন হয়)।
ত্বকে খোসা পড়া বা ঘা (অতিরিক্ত চুলকালে ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয়)।
স্ক্যাবিস হলে তীব্র চুলকানির মূল কারণ হলো শরীরের ত্বকে অবস্থান নেওয়া স্ক্যাবিসের মাইট, তাদের ডিম ও বর্জ্যের বিরুদ্ধে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া। আক্রান্ত স্থান বেশি চুলকালে সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ, যেমন ইমপেটাইগো (Impetigo) হতে পারে, যা চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় করা জরুরি।
স্ক্যাবিস তিন প্রকারের হতে পারে
১. ক্লাসিক স্ক্যাবিস: এটি সবচেয়ে সাধারণ স্ক্যাবিস, যা চুলকানিযুক্ত লালচে র্যাশ ও ত্বকের উপর সরু সুড়ঙ্গরেখার মাধ্যমে চিহ্নিত হয়।
২. ক্রাস্টেড স্ক্যাবিস: এই ধরনের স্ক্যাবিস নরওয়েজিয়ান স্ক্যাবিস নামেও পরিচিত। এটি স্ক্যাবিসের গুরুতর একটি রূপ, যা দুর্বল বা প্রতিরোধক্ষমতা হ্রাসপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বেশি আক্রান্ত করে। এই স্ক্যাবিস অত্যন্ত সংক্রামক এবং এতে ত্বকের উপর পুরু, খসখসে আবরণ তৈরি হয়, যা বিপুল সংখ্যক মাইট দ্বারা পূর্ণ থাকে।
৩. নোডুলার স্ক্যাবিস: কিছু ক্ষেত্রে স্ক্যাবিস সংক্রমণের কারণে উঁচু, নরম গুটি বা নোডিউল তৈরি হতে পারে, যা বিশেষ করে কুঁচকি, বগল এবং যৌনাঙ্গের চারপাশের ত্বকে দেখা যায়।
দৈএনকে/জে,আ
