শিশুদের রক্তস্বল্পতার পেছনে যেসব কারণ


যে কারণে শিশুদের রক্তস্বল্পতা হতে পারে।
অ্যানিমিয়া শুধু শারীরিক দুর্বলতা নয় বরং বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ও শিশুর লেখাপড়াতেও প্রভাব ফেলে।
শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে পুষ্টির গুরুত্ব অপরিসীম। এর অভাবে নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়, যার মধ্যে রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া অন্যতম। বিশেষ করে আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিশুদের মধ্যে রক্তস্বল্পতা একটি খুবই সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ৪২ শতাংশ শিশু আয়রনের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতায় ভুগছে।
শরীরে যখন রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায়, তখন তাকে আমরা রক্তস্বল্পতা বলি। হিমোগ্লোবিন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন, যা শরীরের কোষে অক্সিজেন সরবরাহ করে। এই অক্সিজেন সরবরাহে ঘাটতি ঘটলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও মেধার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
রক্তস্বল্পতা কীভাবে তৈরি হয়?
রক্তে লাল কণিকার (RBC) সংখ্যা কমে গেলে অথবা হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি হলে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। শিশুদের ক্ষেত্রে এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ থাকে:
১. আয়রনের ঘাটতি
শিশুরা দ্রুত বেড়ে ওঠে, তাই তাদের শরীরে আয়রনের চাহিদা বেশি। খাদ্য থেকে পর্যাপ্ত আয়রন না পেলে বা শরীর তা সঠিকভাবে শোষণ করতে না পারলে হিমোগ্লোবিন কমে যায়। এটাই শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত অ্যানিমিয়ার কারণ।
২. পুষ্টির অভাব
খাদ্যতালিকায় যদি পর্যাপ্ত ভিটামিন B12 ও ফোলেট না থাকে, তাও রক্তস্বল্পতা সৃষ্টি করতে পারে। এ দুটি উপাদান লাল রক্তকণিকা তৈরিতে প্রয়োজন হয়।
৩. কৃমিসহ অন্যান্য পরজীবী সংক্রমণ
বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে পেটের কৃমির সংক্রমণ শিশুদের রক্ত ও পুষ্টির শোষণ ব্যাহত করে, ফলে অ্যানিমিয়া দেখা দেয়।
৪. জেনেটিক রক্তরোগ
থ্যালাসেমিয়া, সিকল সেল ডিজিজের মতো জন্মগত রোগের ফলে শরীরে রক্তের স্বাভাবিক গঠন ব্যাহত হয়, যার জন্য দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন।
৫. রক্তক্ষরণ
দুর্ঘটনা, অপারেশন বা নারীদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মাসিক রক্তপাত থেকেও অ্যানিমিয়া হতে পারে।
শিশুদের রক্তস্বল্পতার লক্ষণ
শিশুদের মধ্যে রক্তস্বল্পতার উপসর্গ অনেক সময় অস্পষ্ট থাকে। কিন্তু কিছু লক্ষণ রয়েছে, যেগুলো দেখলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। যেমন–
১. ত্বক ফ্যাকাশে বা হলুদাভ হওয়া।
২. সব সময় ক্লান্ত ও অবসন্ন মনে হওয়া।
৩. হালকা পরিশ্রমেই শ্বাসকষ্ট হওয়া।
৪. মনোযোগে ঘাটতি ও পড়াশোনায় অনাগ্রহ।
৫. খেলাধুলায় আগ্রহ কমে যাওয়া।
৬. খাওয়া-দাওয়ার প্রতি অনীহা।
৭. মাথা ঘোরা বা মাথাব্যথা।
৮. হৃৎস্পন্দন দ্রুত হওয়া।
রক্তস্বল্পতা শনাক্তকরণ
রক্তস্বল্পতা নির্ণয়ের জন্য সবচেয়ে সাধারণ পরীক্ষা হলো CBC (Complete Blood Count), যা রক্তের হিমোগ্লোবিন, লোহিত কণিকার সংখ্যা ও আকার সম্পর্কে ধারণা দেয়। প্রয়োজনে আয়রন, ভিটামিন B12, ফোলেটের মাত্রা এবং থ্যালাসেমিয়ার জন্য বিশেষ পরীক্ষা করা হয়।
চিকিৎসা ও প্রতিকার
রক্তস্বল্পতার চিকিৎসা নির্ভর করে এর মূল কারণের উপর। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সঠিক খাবার, প্রয়োজন অনুযায়ী ওষুধ এবং কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাসে এই সমস্যা দূর করা সম্ভব।
১. আয়রনসমৃদ্ধ খাবার দেওয়া
শিশুর খাদ্যতালিকায় থাকতে পারে—মাংস, ডিম, কলিজা, ডাল, পালং শাক, কলা, আমলকী, কমলা, লেবু ইত্যাদি। ভিটামিন C আয়রনের শোষণ বাড়ায়, তাই ফলমূল দেওয়া জরুরি।
২. আয়রন সাপ্লিমেন্ট
চিকিৎসকের পরামর্শে আয়রনের ট্যাবলেট বা সিরাপ খাওয়ানো যেতে পারে, বিশেষ করে যাদের খাবার থেকে পর্যাপ্ত আয়রন পাওয়া সম্ভব নয়।
৩. কৃমিনাশক ওষুধ
নিয়মিত কৃমিনাশক খাওয়ানো দরকার, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। বছরে অন্তত দুইবার কৃমির ওষুধ খাওয়ানো ভালো।
৪. ভিটামিন ও মিনারেল সাপ্লিমেন্ট
যদি শরীরে ভিটামিন B12 বা ফোলেটের ঘাটতি থাকে, তাহলে সেগুলোর সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়।
৫. পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি
নোংরা পানি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ পরজীবী সংক্রমণের কারণ হতে পারে, যা অ্যানিমিয়া বাড়ায়। তাই শিশুদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
৬. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা
শিশুর বয়স, উচ্চতা ও ওজনের পাশাপাশি রক্ত পরীক্ষা করিয়ে তাদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের অবস্থা জানার চেষ্টা করা উচিত।
প্রতিরোধে করণীয়
শিশুদের রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে কিছু সহজ কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে:
• সুষম ও পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করা।
• বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করা।
• নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা।
• সময়মতো কৃমিনাশক খাওয়ানো।
• বয়স অনুযায়ী প্রয়োজনীয় টিকা দেওয়া।
• খেলাধুলা ও বিশ্রামের সুযোগ রাখা।
• স্কুলে স্বাস্থ্য পরীক্ষা চালু রাখা।
রক্তস্বল্পতা শিশুদের জন্য একটি নীরব সমস্যা—যা তাদের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যতের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে। অ্যানিমিয়া শুধু শারীরিক দুর্বলতা নয় বরং বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ও শিশুর লেখাপড়াতেও প্রভাব ফেলে। তবে সুস্থ জীবনধারা, পরিমিত খাদ্যাভ্যাস, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
শিশুদের সুস্থ, সবল ও বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে এখন থেকেই তাদের পুষ্টি ও রক্তস্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া জরুরি। কারণ, আজকের সুস্থ শিশু-ই আগামীর সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ।
দৈএনকে/জে .আ
