মনের রোগ, যা চুপিচুপি গ্রাস করে—আমরা টেরই পাই না


আমরা প্রায় সবাই জীবনে কখনো না কখনো মানসিক চাপ, দুঃখ, ক্ষোভ বা অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে গিয়ে থাকি। তবে সমস্যাটা তখনই হয়, যখন এই অনুভূতিগুলো আমাদের ভেতরে এমনভাবে গেঁথে বসে যে, আমরা আর বুঝতেই পারি না—আমাদের মধ্যে স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিকের পার্থক্যটা কোথায়। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা অনেক সময় চিৎকার করে না, বরং ধীরে ধীরে নীরবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ভেতর গলে যায়।
অনেকেই মনে করেন মানসিক অসুস্থতা মানেই ‘পাগল হয়ে যাওয়া’। অথচ সত্যি হলো, বেশিরভাগ সময় এটি আসে ক্লান্তি, উদাসীনতা, অতিরিক্ত দায়িত্বশীলতা, ‘সব ঠিক আছি’ বলার মুখোশ থেকে।
নিজেকে হারিয়ে ফেলা
নিজের পছন্দের জিনিসে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, আগে যে কাজগুলোতে আনন্দ পেতেন সেগুলো এখন কেবল দায় মনে হওয়া—এগুলো অবচেতন বিষণ্নতার চিহ্ন।
অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে থাকা
সব সময় নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখা, একা থাকতে না চাওয়া, যেন মনে-মনেই কিছু থেকে পালিয়ে বেড়ানো—এটি মানসিক ক্লান্তির এক রূপ। আমরা বলি ‘আমি তো ঠিক আছি’, কিন্তু এই ব্যস্ততা অনেক সময় নিজেকে অনুভব না করার চেষ্টামাত্র।
শরীর বলছে কিন্তু মন শুনছে না
ঘন ঘন মাথাব্যথা, বুক ধড়ফড় করা, পেট খারাপ বা খাওয়া-ঘুমের অনিয়ম—এইসব শারীরিক উপসর্গ মানসিক চাপে শরীরের প্রতিক্রিয়া হতে পারে। কিন্তু আমরা এগুলোকে ছোট করে দেখি।
নিজের প্রতি বিতৃষ্ণা বা অযোগ্যতা বোধ
যখন মনে হয়, ‘আমি কারও জন্য বোঝা’, ‘আমার কোনো দাম নেই’—তখন সেটি মানসিক অবমূল্যায়নের গভীর সংকেত। কিন্তু আমাদের সমাজ আত্মসম্মান ভেঙে যাওয়াকে ‘নরমাল হিউমিলিটি’ বলে প্রশংসা করে।
কেস স্টাডি: সালমা আপার নীরব যুদ্ধ
সালমা আপা (ছদ্মনাম), ৩৮ বছর বয়সী একজন স্কুল শিক্ষিকা। বাইরের দৃষ্টিতে তিনি একজন আদর্শ মা, দায়িত্বশীল কর্মী এবং পরিপাটি মানুষ। কিন্তু তার ভেতরে চলছিল এক অদৃশ্য যুদ্ধ।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠতেই ইচ্ছা করতো না, কাজ শুরু করলে মাথা ঝিমঝিম করত। ক্লাসে পড়াতে গিয়ে কখনো কখনো কান্না চেপে রাখতে হতো। তিনি ভেবেছিলেন, বয়সের কারণে ক্লান্তি বাড়ছে।
ঘন ঘন অল্প কারণেও ছেলেমেয়েদের উপর রেগে যেতেন, পরে প্রচণ্ড অনুশোচনায় ভুগতেন। রাতে ঘুমাতে পারতেন না, অথচ সকালে উঠে মনে হতো ‘আরও ঘুম দরকার’। শরীরে কোনো বড় অসুস্থতা ধরা পড়েনি। তার স্বামী ও সহকর্মীরা বলতেন, ‘তুমি তো এতই স্ট্রং! কিছুই হয় না তোমার!’
একদিন স্কুলের একটি ওয়ার্কশপে একজন থেরাপিস্ট বলেছিলেন—‘আপনি যতই শক্ত মানুষ হোন, আপনি মানুষ। যদি আপনাকে কেউ জিজ্ঞেস না করে—আপনি কেমন আছেন?, তাহলে নিজের কাছেই সেই প্রশ্ন করুন।’
সেই দিন প্রথমবারের মতো সালমা আপা কান্নায় ভেঙে পড়েন। এরপর তিনি এক মনোবিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন। সেখানে ধরা পড়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরে ‘হাই ফাংশনিং ডিপ্রেশন’-এর মধ্যে ছিলেন—যা বাইরে থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু ভিতরে ধীরে ধীরে মনুষ্যত্বকে গিলে খায়। নিয়মিত থেরাপি এবং পরিবারে বোঝাপড়ার মাধ্যমে এখন তিনি অনেক সুস্থ।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা মানে সব সময়ই চিৎকার বা পাগলামি নয়। অনেক সময় তা হয় নিঃশব্দ আত্মহীনতা, ক্লান্ত ভালো থাকার অভিনয় কিংবা সারাক্ষণ ব্যস্ত থেকে মনের শূন্যতা ঢেকে রাখা।
যখন আপনার মনের ভেতরে কিছু ‘অসামঞ্জস্য’ মনে হয়, যে অনুভূতিগুলো ভাষায় বলা যায় না, তখনই সময় এসেছে থামার, নিজের ভেতরের কথাগুলো শোনার, এবং সাহস করে পেশাদার কারও সাহায্য নেওয়ার।
সাহায্য চাওয়া দুর্বলতা নয়, বরং সবচেয়ে সাহসী সিদ্ধান্ত হতে পারে। নিজেকে ভালোবাসা শুরু হয় নিজের যন্ত্রণাকে গুরুত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়ে।
আমরা প্রায়ই শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে সচেতন থাকি—জ্বর, ব্যথা বা হঠাৎ দুর্বলতা হলে দ্রুত চিকিৎসা নিই। কিন্তু মনের অসুখ? সেটি কি এতটাই দেখা যায়? অনেক সময় মানসিক সমস্যা ধীরে ধীরে আমাদের ভেতরে এমনভাবে গেঁথে বসে যে আমরা বুঝতেই পারি না—আমরা ঠিক নেই।
সচেতন হওয়ার প্রথম ধাপ হলো: অসুস্থতাকে চেনা। কারণ মানসিক স্বাস্থ্য সবসময় “অসুস্থ” মানুষের মতো আচরণ করে না। বরং অনেক সময় এটি হাসির মুখে লুকিয়ে থাকে, এতে ক্লান্ত পরিশ্রমের আড়ালে আত্মপরিচয় হারিয়ে যায়।
যে লক্ষণগুলো অবহেলা করা বিপজ্জনক হতে পারে
১. নিজের মধ্যে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা
আগে যে জিনিসগুলোতে আনন্দ পেতেন, এখন সেগুলো ‘বাজে’ বা ‘ঝামেলা’ মনে হয়? কিছুতেই মন বসে না? এসব বিষণ্নতার সূক্ষ্ম কিন্তু গভীর ইঙ্গিত।
২. অতিরিক্ত হাসিখুশি থাকা, যেন কিছুই হয় না
সব সময় নিজেকে ভালো থাকা প্রমাণ করতে গিয়ে আপনি কি ভেতরে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছেন? এটি হতে পারে স্মাইলিং ডিপ্রেশন—যেখানে বাইরের মুখোশে হাসি, কিন্তু ভেতরে শূন্যতা।
৩. অল্পতেই রাগ বা কান্না চলে আসা
চাপের মধ্যে থাকা মন নিজেকে প্রকাশ করতে পারে আচরণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে—অতিরিক্ত রাগ, খিটখিটে মনোভাব, বা কান্নার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো।
৪. সিদ্ধান্ত নিতে অস্বস্তি
কি খাব, কোথায় যাব, কাকে ফোন দেব—এমন ছোট ছোট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গড়িমসি করা মস্তিষ্কের ক্লান্তির ইঙ্গিত। মানসিক ক্লান্তি আত্মবিশ্বাস হরণ করে।
৫. নির্বোধ অপরাধবোধ বা আত্মসমালোচনা
নিজেকে দোষারোপ করা, আমার জন্যই সব খারাপ হলো—এই ধরনের চিন্তা অনেক সময় বিষণ্নতা ও ট্রমার প্রভাবে জন্ম নেয়।
৬. ঘন ঘন শারীরিক অস্বস্তি—কিন্তু কারণ অজানা
পেট ব্যথা, বুক ধড়ফড়, নিঃশ্বাসের কষ্ট—যার পেছনে কোনো শারীরিক রোগ নেই? এটি সাইকোসোম্যাটিক উপসর্গ হতে পারে, মানসিক সমস্যার শারীরিক প্রতিফলন।
৭. নিজের পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি
আমি কে?’, কেনই বা করছি এগুলো?—নিজেকে হারিয়ে ফেলা, জীবনের উদ্দেশ্য অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া—মানসিক অসংলগ্নতার গভীর সংকেত।
৮. অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা
সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে না থাকলে অস্থিরতা—এটি নিরাপত্তাহীনতা থেকে আসা মানসিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
৯. সব ঠিক আছে—এই কথার ফাঁকে অসুখ লুকিয়ে থাকা
আমরা প্রায়ই বলি ‘আমি ভালো আছি’, অথচ ভেতরে ভেতরে আমরা জানি আমরা ক্লান্ত, খালি, টিকে থাকার চেষ্টা করছি শুধু। এই অস্পষ্টতা কখনও কখনও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।
নিজেকে জানা মানেই সাহসী হওয়া
মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি সবসময় কষ্ট বা কান্না দিয়ে ধরা পড়ে না। কখনো তা আসে নিঃশব্দ ক্লান্তি হয়ে, ভালো থাকার অভিনয় হয়ে। যখন মনের কোনো দিক ‘অসামঞ্জস্য’ মনে হয়—যা ব্যাখ্যা করতে পারেন না, ঠিক তখনই সাহায্য নেওয়ার সময়।
আপনি যদি নিজেকে চেনেন, শুনতে চান, ভালোবাসতে শিখতে চান—তবে সাহস করে বলুন, ‘আমি সাহায্য চাই।’ এটিই হতে পারে আপনার জীবনের মোড় ঘোরানোর প্রথম পদক্ষেপ।
দৈএনকে/জে .আ
