আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্তির পথে মাটির ঘর


চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে গ্রাম বাংলার চিরচেনা মাটির তৈরি ঘরের প্রচলন দিনে দিনে কমে আসছে। হারিয়ে যেতে বসেছে আবহমান কালের গ্রামীণ ঐতিহ্যের এই চিহ্নটি। আধুনিকতার উৎকর্ষতায় বর্তমানে মাটির তৈরি ঘর বিলুপ্তির পথে বললেই চলে। খুব বেশিকাল আগে যেখানে প্রতিটি গ্রামের দু’চারটি মাটির তৈরি ঘর চোখে পড়ত বর্তমানে কয়েকটি ইউনিয়ন মিলেও এই ধরনের ঘর চোখে পড়ে না।
ইতিহাসবিদ ও স্থানীয় বৃদ্ধদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আজ থেকে বিশ-পঁচিশ বছর আগেও গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে মাটির তৈরি ঘর ছিল। উপাদান সহজলভ্য হওয়ায় যে কেউ এই ঘর নির্মাণ করত; যদিও নির্মাণ কাজ বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। নিম্নবিত্তের মানুষ এই ঘরকে তাদের শান্তির আবাস্থল হিসেবে গণ্য করত। স্থানীয়ভাবে গরীরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর বলে পরিচিত ছিল এই ঘর। উচ্চবিত্তরাও শখের বসে এই ঘর নির্মাণ করত।
উপজেলার ১৫ নম্বর ওয়াহেদপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন সেলিম জানান, তিনি তার বাবার রেখে যাওয়া মাটির ঘরেই পরিবার নিয়ে থাকেন। শীত ও গরম উভয় মৌসুমে আরামদায়ক এই ঘর। সাধারণত, এঁটেল মাটি দিয়ে এসব ঘর তৈরি করা হতো। ভালো মানের পরিচ্ছন্ন মাটি পানি দিয়ে ভিজিয়ে কাদায় পরিণত করে সেই কাদা দিয়ে ২০-৩০ ইঞ্চি চওড়া করে মাটির দেয়াল তৈরি করা হত।
মাটির ঘরের দেয়াল তৈরি করতে বেশ সময় লাগে। কারণ একসঙ্গে বেশি উঁচু করে দেয়াল তৈরি করা যায় না। প্রতিবার এক দেড় ফুট উঁচু করে দেয়াল তৈরি করা হয়। কয়েকদিন পর এই অংশ শুকিয়ে গেলে তার উপর আবার একই উচ্চতার দেয়াল তৈরি করা হয়। এভাবে দেয়াল ১০-১২ ফুট উঁচু হলে বেশ কিছুদিন ধরে রোদে শুকানো হয়। তারপর এই দেয়ালের ওপর বাঁশ অথবা কাঠের চাল তৈরি করে খড় বা টিন দিয়ে ছাউনি দেওয়া হয়। একটি মাটির ঘর তৈরি করতে প্রায় দেড় থেকে দুই মাস পর্যন্ত সময় লাগে। চাইলে এই ঘর দোতলা করেও তৈরি করা যায়।
সাধারণত বন্যা, ভূমিকম্প, ঝড় কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এসব ঘর শতাধিক বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। পরিবারের গৃহিণীরা নরম হাতের কোমল ছোঁয়ায় সুনিপুনভাবে কাদা দিয়ে লেপন দিয়ে বছরের পর বছর এই ঘরের সৌন্দর্য টিকিয়ে রাখে। সময়ের ঘূর্ণিপাকে সেই মাটির ঘর বর্তমানে খুব একটা চোখে পড়ে না বললেই চলে। তবে পূর্ব পুরুষের স্মৃতি ধরে রাখতে অনেকেই দু’একটা মাটির ঘর টিকিয়ে রেখেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষের বসতির চেহারা পাল্টাতে শুরু করলেও মূলত প্রাকৃতিক দুর্যোগে মাটির ঘরের বেশি ক্ষতি সাধিত হয় বলেই মানুষ দিন দিন মাটির ঘরের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ভারত থেকে সৃষ্ট উজানের পানির ভয়াবহ বন্যা সারা দেশের সঙ্গে মিরসরাইয়েও ক্ষতি সাধিত করে। এ সময় এখানকার মাটি তৈরি ঘরগুলোর ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। এরপর থেকে মানুষ মাটির ঘর তৈরির আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। যা কিছু মাটির ঘর ছিল, ২০২৪ সালের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় অনেকে ঘর ভেঙে গেছে। এরপর শুরু হয় পাকা দেয়াল, টিনের বেড়া ও চাউনি দিয়ে ঘর তৈরির রেওয়াজ। এছাড়াও এ ধরনের ঘর প্রতি বছর মেরামত করার ঝামেলাও ঘর কমে যাওয়ার একটা কারণ।
সেই থেকে এ ঘরের সংখ্যা কমতে শুরু করে। বর্তমানে এই ঘর খুব একটা চোখে পড়ে না। মাটির ঘরের স্থান দখল করে নিয়েছে ইট, সিমেন্ট, বালি ও রডের তৈরি পাকা দালান। মিররসাই উপজেলার ১ নম্বর করেরহাট, ২ নম্বর হিঙ্গুলী, ১৩ নম্বর মায়ানী, ১৪ নম্বর হাইতকান্দি, ১৫ নম্বর ওয়াহেদপুরে দু’একটি মাটির ঘর চোখে পড়ে। বর্তমানে এই ঘর প্রায় শূন্যের কোটায় ঠেকেছে। হারিয়ে যেতে বসেছে বাঙালির ঐতিহ্যের এই চিহ্নটি। হয়তো সেদিনটি খুব বেশি দূরে নয়; যেদিন মাটির ঘরের কথা মানুষের মন থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে। আর আগামী প্রজন্ম রুপকথার গল্পেই এই ঘরকে স্থান দিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করবে।
এই বিষয়ে কবি ও সাহিত্যিক মাহমুদ নজরুল বলেন, কালের বিবর্তনে মাটির ঘর হারিয়ে যাচ্ছে। এখন মানুষ ইট, বালু, সিমেন্ট দিয়ে দালান তৈরি করে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন কেউ মাটির ঘর নির্মাণ করে না। তবে এখনো কিছু এলাকায় এখনো কিছু মাটির ঘর রয়েছে বলে জানান তিনি।
দৈএনকে/জে .আ
