নির্যাতনের বিরুদ্ধে আজ বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ ও সচেতনতার দিন


আজ ২৬ জুন, নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের সমর্থনে আন্তর্জাতিক দিবস। মানবজাতি যখন আধুনিকতার পথে অগ্রসর হচ্ছে, তখনো বিশ্বজুড়ে অনেক মানুষ নানা রকম দুঃখ ও অবমাননার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। কোথাও মতের পার্থক্য, কোথাও পরিচয়ের ভিন্নতা, আবার কোথাও সাংস্কৃতিক ব্যবধান এসব কারণে মানুষ আজো সম্মানহানিকর আচরণের শিকার হচ্ছেন। অথচ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী, যে কোনো ধরনের শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ।
জাতিসংঘ নির্যাতনকে মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৯৮৪ সালে গৃহীত ‘কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট টর্চার অ্যান্ড আদার ক্রুয়েল, ইনহিউম্যান অর ডিজগ্রেডিং ট্রিটমেন্ট অর পানিশমেন্ট’ চুক্তিটি ১৯৮৭ সালে কার্যকর হয়, যার আওতায় বর্তমানে ১৭৪টি দেশ যুক্ত হয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে নির্যাতনকে আন্তর্জাতিকভাবে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা জরুরি অবস্থার অজুহাতেও কাউকে শারীরিক বা মানসিকভাবে নির্যাতন করা যাবে না। চুক্তিভুক্ত প্রতিটি দেশকে নিজ নিজ আইনে নির্যাতন প্রতিরোধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়েছে।
নির্যাতন শুধু শারীরিকভাবে কষ্ট দেওয়া নয়; কারো মর্যাদা, অনুভূতি অথবা মানসিক স্থিতি নষ্ট করাও এর পরিধির মধ্যে পড়ে। কারো কাছ থেকে জোরপূর্বক তথ্য আদায়, শাস্তি দেওয়া বা ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে যদি ইচ্ছাকৃতভাবে দেহ বা মনের ক্ষতি করা হয়, তবে তা আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এখনো বিভিন্ন স্থানে এমন পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, যেখানে মানুষ তাদের সম্মান ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই প্রক্রিয়াগুলো নানা রকম রূপে ঘটতে পারে। কখনো পারিবারিক সম্পর্কে, কখনো সামাজিক ব্যবস্থায়, আবার কখন ব্যক্তি পর্যায়ে।
বিভিন্ন বয়সের মানুষই এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হন। শিশুরা অনেক সময় শাসনের নামে অপ্রয়োজনীয় কঠোরতা বা হিংসার মুখোমুখি হয়। নারীরাও নানাভাবে মানসিক ও সামাজিক চাপে থাকেন। অন্যদিকে কোনো ব্যক্তি তার মতামত বা অবস্থান প্রকাশ করলে অনেক সময় তা সহানুভূতির সঙ্গে না নিয়ে তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। গণমাধ্যমে কাজ করা ব্যক্তি, শিক্ষার্থী কিংবা সংবেদনশীল পেশায় থাকা অনেক মানুষও তাদের কাজের পরিপ্রেক্ষিতে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন।
এই বাস্তবতা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে জাতিসংঘ ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠা করে ‘ভলান্টারি ফান্ড ফর ভিকটিমস অব টর্চার’। এই তহবিলের মাধ্যমে যারা কঠিন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন, তাদের জন্য চিকিৎসা, আইনি সহায়তা, পুনর্বাসন এবং মানসিক সেবা প্রদান করা হয়। কারণ নির্যাতনের ক্ষত কেবল দেহে সীমাবদ্ধ থাকে না, সেটি দীর্ঘদিন ধরে হৃদয় ও মানসিক জগতে স্থায়ী ছাপ ফেলে। জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডস তার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে জানান, তিনি অনেক মানুষের মুখ ও গল্প মনে রেখেছেন, যেগুলো তাকে এই বিষয়ে কাজ চালিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে।
তবে নির্যাতনের মতো সংবেদনশীল বিষয় শুধু আন্তর্জাতিক চুক্তি বা আইন দিয়ে প্রতিরোধ সম্ভব নয়। চাই সমাজের সবস্তরে সচেতনতা, মানবিক মূল্যবোধের চর্চা এবং সহনশীলতা। পরিবারে শিশুদের প্রতি সহানুভূতির দৃষ্টি, নারীর প্রতি সম্মান ও মর্যাদা, মতভিন্নতাকে গ্রহণযোগ্যতার সঙ্গে দেখা ইত্যাদি। এসব চর্চা প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে কোনো আইন কার্যকরভাবে সমাজে কাজ করতে পারবে না।
আজকের দিবসটি আমাদের জন্য একটি বার্তা। এই দিনটি আমাদের ভাবায়, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আমরা কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। আমরা কি অন্যের যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করি! আমরা কি প্রতিবাদ জানাই, যখন অন্যায় দেখি? যদি এই প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয়, তবেই সভ্যতা সত্যিকার অর্থে এগিয়ে যাবে। আর যদি উত্তর ‘না’ হয়, তবে আমাদের অর্জিত উন্নয়ন একদিন ভঙ্গুর হয়ে পড়বে। কারণ নির্যাতন শুধু একজন মানুষের ক্ষতি করে না, সে পুরো সমাজের শান্তি ও সাম্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
দৈএনকে/জে .আ
