প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর বড় কারণ: অদক্ষ ধাত্রী


গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ বাড়িতেই অদক্ষ ধাত্রীর মাধ্যমে ডেলিভারি হয়ে থাকে, যে কারণে মাতৃমৃত্যু রোধ করা কঠিন হচ্ছে।এমন অবস্থায় মা ও নবজাতকের সুরক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি নিশ্চিতের তাগিদের পাশাপাশি কমিউনিটি পর্যায়ে মিডওয়াইফদের পদায়নের দরকার। স্বাধীনতার পর দেশে প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন মা এবং ৫০০ নবজাতকের মৃত্যু হতো। বর্তমানে তা অনেক কমিয়ে আনা হয়েছে। এখন প্রতি লাখে ১৪৫ জন মায়ের মৃত্যু হয়। তবে এটিকে আরও কমিয়ে ১০০’র নিচে নামিয়ে আনতে হবে।
মাতৃমৃত্যু প্রধানত দুইটি কারণে হয়ে থাকে। প্রথমটি হলো বাড়িতে অদক্ষ ধাত্রীর মাধ্যমে ডেলিভারি, দ্বিতীয়ত হলো রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনি। মা ও শিশুদের মৃত্যু মোকাবিলায় ডেলিভারি রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু রোগীরা এমন অবস্থায় হাসপাতালে আসেন, যখন আর কিছুই করার থাকে না। মাতৃমৃত্যু রোধে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে মায়েদের হাসপাতালে আনা। তাদের হাসপাতালে আনতে পারলে মাতৃমৃত্যু সমস্যা বহুলাংশেই সমাধান হয়ে যাবে।
গর্ভবতী নারীর সেবায় প্রতিটি স্তরে চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। তবুও অনেকে প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারির জন্য হাসপাতালে যান না। গর্ভাবস্থায় মাত্র ৬৭ শতাংশ মা ৪ বার চিকিৎসকের কাছে আসেন। মায়েদের এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে।
একটা সময় ছিল যখন গ্রামাঞ্চলে সন্তান প্রসবের প্রধান ভরসা ছিলেন ধাত্রী বা দাইয়েরা। কিন্তু কালের পরিক্রমায় বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের গর্ভবতী নারীরা হাসপাতালে চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে সন্তান জন্মদানকে আগের চেয়ে অনেকটা প্রাধান্য দিচ্ছেন। কারণ নারীরা আগের তুলনায় প্রসব সম্পর্কিত ঝুঁকি এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সচেতন হচ্ছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গ্রামাঞ্চলের ৪৭% নারী এখনও বাড়িতে ধাত্রীদের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিয়ে থাকেন। যদিও এসব ধাত্রীদের মাত্র ৩% সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত।
অদক্ষ ধাত্রীদের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে শিশু এবং মা উভয়ের জন্যই অনেক তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। প্রসবকালীন জটিলতার ক্ষেত্রে অনেক সময়ে দেখা যায়, বাচ্চার অবস্থান নির্ধারণ না করেই ডেলিভারি করা হয়। এটি জরায়ু এবং কোলন ছিঁড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। এছাড়া, অতিরিক্ত চাপের কারণে মা ও শিশু উভয়েই অন্যান্য জটিলতার সম্মুখীন হতে পারে।
জরায়ুর স্থানচ্যুতির সমস্যাটি মূলত অনুপযোগী প্রসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে এটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
ধাত্রীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করে বা তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রসব সংক্রান্ত ঝুঁকি কমিয়ে আনা যেতে পারে। তবে শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও নারীরা সন্তান প্রসবের ক্ষেত্র হিসেবে হাসপাতালকেই অনেকে বেছে নিচ্ছেন। আর এর মাধ্যমেই অনুপযুক্ত সন্তান প্রসব বিষয়ক সমস্যা সমাধানের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
সন্তান প্রসবের ব্যথা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর কষ্টকর ব্যথার মধ্যে একটি। এই ব্যথার ভয়ে অনেকেই তাই স্বাভাবিক প্রসব এড়িয়ে অস্ত্রোপচার করে সন্তান প্রসব করাই শ্রেয় মনে করেন। তবে অস্ত্রোপচার না করেও ব্যথামুক্তভাবে প্রসব সম্ভব।
ডেলিভারি বা সন্তান প্রসবের বিষয়টি নিয়ে আমাদের জনমনে কিছু প্রশ্ন আছে। আমরা শুনতে পাই এখন গাইনি চিকিৎসকদের কাছে সন্তান প্রসবের বিষয়ে গেলেই তাঁরা সিজারের কথা বলেন। স্বাভাবিক প্রসবের দিকে কেউই আগ্রহ দেখান না। এই বিষয়টি কী এবং স্বাভাবিক প্রসব মানে কী? আদৌ কি আমরা জানি এবং মানি।
নরমাল ডেলিভারি মানে হচ্ছে স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব। অর্থাৎ একটি গর্ভে সন্তান থাকবে পূর্ণ বয়স পর্যন্ত। আর সেই গর্ভের সন্তানটি স্বাভাবিক অবস্থানে থাকবে, অর্থাৎ শিশুর মাথা নিচের দিকে থাকবে। স্বাভাবিক উপায়ে বা স্বাভাবিক নিয়মে গর্ভবতী মায়ের প্রসব বেদনা উঠবে। শেষ পর্যন্ত একটি সুস্থ সন্তানের জন্ম হবে। একজন মা সুস্থ থাকবে। এই সম্পূর্ণ পরিস্থিতিকে আমরা বলি স্বাভাবিকভাবে সন্তানের প্রসব।
তবে এই স্বাভাবিক ঘটনা স্বাভাবিকভাবে হয় না। একটু ব্যাহত করে আমরা সিজারিয়ানের দিকে বেশি যাচ্ছি বলে একটি আলোচনা আছে। এর যথার্থতা কতখানি?
এর যথার্থতার অনেকগুলো দিক । একটি হলো রোগীর দিক। এমনিতে কিছু কারণ রয়েছে যেগুলোর জন্য স্বাভাবিক ডেলিভারির বদলে অস্ত্রোপচার করে বাচ্চা প্রসব করাতে হবে। তো সেই জিনিসগুলো কী? বেশ কিছু। যেমন মায়ের যদি কোনো জটিলতা থাকে। দেখা গেল মায়ের উচ্চ রক্তচাপ আছে। কিংবা অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস আছে। অথবা মা একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছে; যেমন হার্টের রোগে ভুগছে। কিংবা মায়ের বয়স বেশি বা বয়স অনেক কম। অর্থাৎ ১৬ বছরের নিচে কিংবা ৩৫ বছরের ওপরে। কিংবা মায়ের উচ্চতাও কম। এই দিক থেকে এসব ব্যাপারগুলো থাকে।
আর বাচ্চার দিক থেকে যেটা থাকে, গর্ভফুলটা হয়তো জরায়ুমুখের দিকে থাকে, নিচের দিকে থাকে। কিংবা বাচ্চার অবস্থান হয়তো ঠিক নেই। বাচ্চার মাথা হয়তো নিচের দিকে নেই। তা ছাড়া দেখা গেল মায়ের জরায়ুতে কোনো টিউমার আছে যে কারণে স্বাভাবিক প্রসব ব্যাহত হতে পারে। আরেকটি হতে পারে বাচ্চাটির ওজন যে রকম, বাচ্চার আকার আকৃতি যে রকম বড়, মায়ের যে তলপেটের হাড়ের খাঁচা আছে, সেটি হয়তো দেখা গেল সে রকম নয়, ছোট। সে কারণে আমরা মনে করি এখান দিয়ে হয়তো স্বাভাবিক প্রসব হবে না। এই রকম কিছু বিষয় থাকে।
কিংবা কোনো মায়ের হয়তো এ রকম থাকে আগে একবার কিংবা দুবার অস্ত্রোপচার হয়ে বাচ্চা প্রসব হয়েছে, সে কারণে তখন আমরা হয়তো স্বাভাবিক প্রসবের কথা চিন্তা না করে তাকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসবই সমর্থন করি। এটা হলো বৈজ্ঞানিক তথ্য।
আরেকটা ব্যাপার, মায়ের এবং পারিবারিক দিক থেকে আমাদের ওপরে চাপ থাকে, সেটা হচ্ছে অনেক দিন পরে বাচ্চা হচ্ছে এবং কোনো পরিবার সেই ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। কিংবা তারা চিন্তা করছে আমরা বেশি বাচ্চা নেব না তাহলে কেন অস্ত্রোপচার করাব না। আর একটি হলো, ব্যথার যে বিষয়টি রয়েছে সেই ব্যথা সে সহ্য করতে পারবে না।
আরো অনেক ভুল ধারণা মানুষের মাথার মধ্যে ঢুকে গেছে। তারা মনে করছে, সিজারিয়ান ভালো। এভাবে বাচ্চা ভালোভাবে জন্ম হয়। স্বাভাবিক প্রসবে অনেক ঝুঁকি আছে। এই ভুল কিছু তথ্য মায়েদের মধ্যে ঢুকে গেছে।
চিকিৎসকের দিক থেকে যে বিষয়টি ঘটে, চিকিৎসক প্রসবকালীন সম্পূর্ণভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করবেন, সে সময়টুকু দেবেন এবং চাহিবা মাত্র ওই চিকিৎসককে পাওয়া যাবে কিংবা অফিস সময়ের বাইরে হোক কিংবা অফিস সময়ে ভেতরে হোক- এই চিকিৎসককে পাওয়া যাবে সময়মতো এটাও আসলে সম্ভব নয়। তাই চিকিৎসকের চিন্তা থাকে, আমি অস্ত্রোপচার করেই হয়তো ঠিকঠাকমতো একটি বাচ্চা প্রসব করব। এতে আমি চিন্তামুক্ত থাকলাম। এসব বিভিন্ন কারণে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বাচ্চার প্রসব বাড়ছে।
অনেকেই বলে একবার যদি সিজার হয় তাহলে সেই মায়ের কি স্বাভাবিক প্রসব প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়? তাকে আবারও সিজারের দিকে যেতেই হয় কিন্তু বিষয় টি হচ্ছে, আগের সিজারটি কেন হয়েছিল, তার ওপর বিষয়টি অনেকটা নির্ভর করে। যদি এমন হয়ে থাকে যে আগে এমন কোনো কারণ ছিল যে কারণে মায়ের অস্ত্রোপচার করতে চিকিৎসক বাধ্য হয়েছিলেন, সেই ঘটনা আবারও ঘটতে পারে। তখন আমরা সেই মাকে স্বাভাবিকভাবে প্রসবের জন্য আর বলি না।
প্রসব বেদনার ধরন কেমন হতে পারে একজন মা কী ধরনের ব্যথা উঠলে বুঝতে পারবেন এখন তাঁর সন্তান হওয়ার সময় হয়েছে?
প্রসব বেদনা একটি ছন্দময় বেদনা। এটি কিছুক্ষণ পরপর ওঠে। তীব্রতা বাড়ে এবং স্থায়িত্ব বাড়ে। দেখা গেল প্রথমে দুই ঘণ্টা পর পর ব্যথাটা উঠত। থাকত ১০ সেকেন্ড, তারপর এক ঘণ্টা পরপর ওঠে, থাকে ২০ সেকেন্ড, এভাবে তীব্রতা বাড়ে। স্থায়িত্ব বাড়ে। ব্যথাটি তলপেটে যায়, কোমরে যায়, দুই পায়ের মাঝে যায় এবং জরায়ুতে মা চাপ অনুভব করে। এভাবে ব্যথার তীব্রতা এতই বাড়ে যে সে মায়ের আর বসে থাকা সম্ভব নয়; এবং কোনো ওষুধে সে ব্যথা থামবে না। এই ব্যথাকে আমরা বলি সত্যিকারের প্রসব বেদনা
তাই আসুন আমরা সবাই সচেতন হয় এবং নরমাল ডেলিভারি করতে গেলেও ডাক্তার কিংবা হাসপাতালের শরনাপন্ন হয়ে যেন ডেলিভারি করি।তাহলে স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের আর ঝুঁকি থাকলো না।
মা ও শিশু উভয়েরই মৃত্যুহার আর জটিলতা কমাতে নিরাপদ প্রসবের বিকল্প নেই। নিরাপদ প্রসবও হতে হবে নিরাপদ জায়গায়। হাসপাতাল হবে মানসম্মত ও পরিচ্ছন্ন। নিরাপদ যন্ত্র দিয়ে নিরাপদ হাতে প্রসব হতে হবে। প্রসবের জন্যে প্রশিক্ষিত দাই থাকতে হবে। প্রসবকালীন জটিলতায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসকের কাছে রেফারেল ও দরকার হলে সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে ডেলিভারির ব্যবস্থা থাকতে হবে। সদ্যজন্মানো শিশুর যেকোনো জটিলতায় তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুব্যবস্থা থাকতে হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৩ সালের একটি প্রতিবেদন বলছে, দেশে এখনো বাড়িতে সন্তান প্রসবের হার প্রায় ৩৩ শতাংশ। তারও বেশ বড় একটা অংশের প্রসব অদক্ষ দাইয়ের হাতে হয়ে থাকে। ফলে একদিকে যেমন মায়েরা প্রসবকালীন বিভিন্ন জটিলতার শিকার হন, তেমনই নবজাতকের জটিলতাও নেহাত কম হয় না। উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা পেলে যেখানে প্রসূতি মা ও সন্তান দুজনই সুস্থ থাকত, সেখানে তাদের কেউ একজন বা দুজনই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। এই রকম অনিরাপদ প্রসবের মৃত্যুর নির্মম উদাহরণ অহরহ আছে।
লেখক: ডা.ফারহানা ইয়াছমিন, স্ত্রী রোগ ও প্রসূতিবিদ্যা চিকিৎসক ও সার্জন, এক্স এইচ.এম.ও, সদর হাসপাতাল ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
দৈএনকে/জে .আ
