ভোলার সাবেক এসপি মোকতার হোসেনের কালো অধ্যায়


দীর্ঘদিন ধরে নারী পুলিশ সদস্যদের যৌন হয়রানির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনিক বা আইনি কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি ভোলার সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) মোকতার হোসেনের বিরুদ্ধে। বর্তমানে অতিরিক্ত ডিআইজি (ওএসডি) হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত এই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
২০১৬ সালে ভোলা জেলায় যোগদানের পর থেকেই এসপি মোকতার হোসেনের বিরুদ্ধে নারী পুলিশ কনস্টেবলদের বিভিন্নভাবে হয়রানি, প্রলোভন ও শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে চাপ প্রয়োগের অভিযোগ উঠে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি পরিকল্পিতভাবে অবিবাহিত ও আকর্ষণীয় নারী কনস্টেবলদের থানা বা ফাঁড়ি থেকে পুলিশ লাইনে বদলি করে আনেন। পরে এসআই আশরাফ ও অর্ডারলি কংস্টেবল মনিরের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ স্থাপন করেন।
ভুক্তভোগীদের দাবি, তারা ফোনালাপে এসব প্রস্তাবের প্রমাণ রেকর্ড করে পুলিশ সদর দপ্তর ও উইমেন পুলিশ নেটওয়ার্কের প্রধান সাবেক ডিআইজি মিলি বিশ্বাসের কাছে অভিযোগ করেন। সেই প্রেক্ষিতে তদন্ত নির্দেশ থাকলেও তা থেমে যায় রহস্যজনক কারণে।
সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছানো একাধিক অডিও রেকর্ডে শোনা যায়, সাবেক এসপি মোকতার হোসেন এক নারী পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কুরুচিপূর্ণ ও ব্যক্তিগত কথোপকথনে জড়িত ছিলেন, যেখানে তিনি সরাসরি ‘দেখা করার’ এবং ‘বিশেষভাবে প্রস্তুত হয়ে আসার’ নির্দেশ দিচ্ছেন। এই রেকর্ড প্রসঙ্গেই অভিযোগকারীরা বলেন, "এসপি স্যারের প্রভাব এতই বেশি যে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না।"
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, সিরাজগঞ্জে তার পূর্ববর্তী কর্মস্থলেও তিনি একই ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। সংশ্লিষ্টদের দাবি, তার বিরুদ্ধে একাধিক কল রেকর্ড, সাক্ষ্য এবং লিখিত অভিযোগ থাকলেও ‘অদৃশ্য প্রভাব’ ও প্রশাসনিক আনুকূল্যে তিনি রক্ষা পেয়ে আসছেন।
নারী হয়রানির অভিযোগ ছাড়াও সাবেক এসপি মোকতার হোসেনের বিরুদ্ধে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। ভোলা জেলায় দায়িত্ব পালনকালে তিনি ঢাকার অভিজাত এলাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, দামী প্রাইভেট কার, উত্তর বাড্ডায় জমি এবং বিভিন্ন ব্যাংক একাউন্টে নাম-বেনামে অর্থ জমা করেন বলে দাবি উঠেছে।
স্থানীয় ও পেশাগত মহলে প্রশ্ন উঠেছে, একজন সরকারি কর্মকর্তা হঠাৎ এত সম্পদের মালিক কীভাবে হলেন? এসব অভিযোগেরও কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি বলেই অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
যৌন হয়রানির অভিযোগ জানানো অনেক নারী পুলিশ সদস্যকেই শাস্তিমূলকভাবে ভোলার বাইরে বদলি করা হয়, যা নিয়োগবিধি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এতে তারা পেশাগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এক ভুক্তভোগী বলেন, আমরা শুধু বিচার চেয়েছিলাম, উল্টো বদলি করে আমাদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে।
বর্তমানে তিনি অতিরিক্ত ডিআইজি (ওএসডি), কিন্তু কোনো তদন্তের মুখোমুখি নন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দপ্তর বা পুলিশ সদর দপ্তর তার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। এই বিচারহীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মানবাধিকার কর্মী, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা এবং সাংবাদিক মহল।
নারী পুলিশ সদস্যদের পেশাগত নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষায়, এবং সরকারি দায়িত্বে থেকে অসদাচরণের অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মহল। প্রশাসনের কাছে এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার প্রত্যাশা করছেন ভুক্তভোগীরা।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভ্যন্তরে যদি নারী সদস্যরা নিজ দায়িত্ব পালনে নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন, তবে তা পুরো ব্যবস্থার ওপর প্রশ্ন তোলে। একটি কল্যাণরাষ্ট্রে এ ধরনের অভিযোগ বিচারহীন থেকে গেলে তা ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ সংকট ডেকে আনবে। প্রয়োজন দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত, এবং অপরাধ প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা।
