জুলাই আন্দোলনে গণহত্যার মামলার আসামি শাহাদাত বিজিএমইএ নির্বাচনে প্রার্থী!


২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত গণহত্যায় গুলশান থানায় এজাহারভুক্ত আসামি মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন—বর্তমানে বিজিএমইএ (বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন)-এর আসন্ন নির্বাচনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছেন। বিষয়টি ঘিরে তৈরি হয়েছে প্রবল বিতর্ক ও উদ্বেগ।
"গণহত্যার অভিযোগে আসামি থাকা অবস্থায় দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প উদ্যোক্তা সংগঠনের নেতৃত্বে এগিয়ে আসা নৈতিক, আইনগত ও সাংগঠনিক দিক থেকে গভীর উদ্বেগজনক।" – বলছেন একাধিক পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট প্রবীণ উদ্যোক্তা, যাঁরা প্রকাশ্যে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।
জুলাই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও শাহাদাতের নাম ওঠা:
২০২৪ সালের জুলাই মাসে, সরকারবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে সংঘটিত সহিংস ঘটনায় বেশ কয়েকটি গণহত্যার অভিযোগ ওঠে। তখন গুলশান থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলার এজাহারে মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেনের নাম উঠে আসে “সহযোগী ভূমিকা পালনের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা” অভিযোগে। মামলাটি এখনো বিচারাধীন। তবে রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক দুর্বলতায় তদন্ত এগোচ্ছে ধীর গতিতে।
শেখ রেহানার ঘনিষ্ঠতা ও রাজনৈতিক সংযোগ:
ব্যবসায়ী মহলে আলোচিত তথ্য অনুযায়ী, শাহাদাত হোসেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাঁর ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য ব্যাপক প্রসার লাভ করে। বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনকালে তৈরি পোশাক খাতে সরকারের সুবিধা ও ছাড়ের সুযোগ নিয়ে ফরটিস গ্রুপকে বৃহৎ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন তিনি।
ফরটিস গ্রুপের ব্যবসা সম্প্রসারণ ও আলোচিত অবস্থান:
মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন ফরটিস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কর্ণধর। বাংলাদেশ-জার্মানি যৌথ মালিকানাধীন এ প্রতিষ্ঠানটি মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানিতে সক্রিয়। বর্তমানে ফরটিস গ্রুপের পাঁচটি নিজস্ব উৎপাদন ইউনিট রয়েছে। এছাড়া তারা রিয়েল এস্টেট, হোটেল ও রিসোর্ট, অবকাঠামো, কৃষি ও খেলাধুলা খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে।
ফরটিস গ্রুপের অধীন প্রতিষ্ঠানসমূহ:
Habitus Fashion Ltd.
KA Design Ltd.
Quattro Fashion Ltd.
Fortis Garments Ltd.
Arrow Fabric Ltd.
Sarah Resort (গাজীপুর)
Fortis Downtown Resort
তাঁর মালিকানাধীন Sarah Resort এবং Fortis Football Club নিয়েও বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে সরকারি অনুদান ও জমি বরাদ্দ নিয়ে।
বিজিএমইএ নির্বাচন ও প্রশ্নবিদ্ধ অংশগ্রহণ:
দেশের পোশাক খাতের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠন বিজিএমইএর আবারও নেতৃত্বে আসতে নির্বাচনে অংশ নেয়া ও শাহাদাত হোসেনের সক্রিয়তা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, “একজন এজাহারভুক্ত হত্যা মামলার আসামি কিভাবে এই সংগঠনের নেতৃত্বে আসার সাহস দেখান?”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজিএমইএ-র একজন সাবেক সহ-সভাপতি বলেন, “এই সংগঠনের নেতৃত্বে এমন বিতর্কিত চরিত্র আসলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের পোশাক খাতের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
নৈতিক প্রশ্ন ও আইনি জটিলতা:
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মামলা বিচারাধীন থাকাকালে কোনও ব্যক্তি ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রাতিষ্ঠানিক নির্বাচন করতে পারেন, তবে এ ধরনের উচ্চপদে আসার ক্ষেত্রে নৈতিকতা ও সম্মানবোধের প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ। বিজিএমইএ-এর গঠনতন্ত্রে অবশ্য এ বিষয়ে নির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা নেই, তবে “গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত” ব্যক্তি নির্বাচন করতে পারবেন না – এমন একটি ধারা যুক্ত করার প্রস্তাব বহুদিন ধরেই আলোচনায় রয়েছে।
জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের মামলায় নাম থাকা অবস্থায় মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেনের বিজিএমইএ নির্বাচনে অংশগ্রহণ শুধু রাজনৈতিক নয়, ব্যবসায়িক মহলেও গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে—গণতন্ত্রের পথে আন্দোলনে রক্তদানের ইতিহাস রচিত হওয়া একটি সময়ের সঙ্গে জড়িত একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে দেশের বৃহৎ রপ্তানি খাতের নেতৃত্বে আনার নৈতিক ও রাজনৈতিক বার্তা কী?
