বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
Natun Kagoj
শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ও বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি:

অস্থিরতার মাঝে নতুন ভবিষ্যৎ?

অস্থিরতার মাঝে নতুন ভবিষ্যৎ?
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

গত আগস্ট মাসের ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিয়েছে। সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া এ আন্দোলন দ্রুতই সরকারবিরোধী এক বৃহৎ গণবিক্ষোভে পরিণত হয়। পুলিশের দমন-পীড়ন, সাংবাদিক নিপীড়ন এবং সর্বোপরি নিরাপত্তা বাহিনীর গুলি চালানোর ঘটনায় জনমনে ক্ষোভ আরও তীব্র হয়। পরিণতিতে, ব্যাপক জনসমর্থন পাওয়া এই আন্দোলন শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করে।

এখন বাংলাদেশ এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, তবে নানা চ্যালেঞ্জ তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং প্রশাসনিক পুনর্গঠনের প্রশ্নে দেশ এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই নিবন্ধে আমরা বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা, অন্তর্বর্তী সরকারের চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা পর্যালোচনা করব।

বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একাধিপত্য বজায় রেখেছিল আওয়ামী লীগ। তবে ক্রমবর্ধমান দমননীতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকোচন, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ সাধারণ জনগণের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করছিল। বিশেষত, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।

* প্রথমে এটি ছিল কোটা সংস্কার ও শিক্ষাখাতে বৈষম্য দূর করার আন্দোলন।
* সরকার আন্দোলন দমন করতে পুলিশি নির্যাতন ও গ্রেফতারের পথ বেছে নেয়।
* ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয়।
* পুলিশের গুলিতে সাংবাদিক হাসান মেহেদি নিহত হওয়ার পর আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
* সাধারণ জনগণ, পেশাজীবী এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এই আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে।
* দেশজুড়ে অবরোধ, ধর্মঘট এবং বিক্ষোভের ফলে পরিস্থিতি সরকার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
* শেষ পর্যন্ত, আন্তর্জাতিক চাপ এবং সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ অবস্থানের ফলে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং পরে ভারতে নির্বাসিত হন।

শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে এসেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি একজন বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। তবে, তার নেতৃত্বাধীন সরকার গঠনের পর থেকেই বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।

১. আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ
সরকার পতনের পরপরই কিছু এলাকায় সহিংসতা ও অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাকর্মী পালিয়ে গেছেন, আবার কেউ কেউ নতুন সরকারের সাথে সমঝোতার চেষ্টা করছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিরপেক্ষ রাখা এবং পরিস্থিতি শান্ত করা নতুন সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।

২. বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের পুনর্গঠন
গত এক যুগ ধরে বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার, প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা এবং দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের অপসারণ—এসবই অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

৩. মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দায়ীদের বিচার
আওয়ামী লীগের শাসনামলে যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, বিশেষত বিরোধী দল ও সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন, সেগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা দরকার। আন্তর্জাতিক মহলও এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের ওপর নজর রাখছে।

৪. গণতান্ত্রিক নির্বাচন আয়োজন
নতুন সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা। তবে নির্বাচন কমিশন সংস্কার, ভোটার তালিকা পুনর্গঠন এবং নিরপেক্ষ ভোটগ্রহণ নিশ্চিত করাও এক বড় চ্যালেঞ্জ।

৫. অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার
রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিনিয়োগ কমেছে, রিজার্ভ সংকট চলছে, মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। ব্যবসায়ীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠন করাও জরুরি।

বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নতুন সরকার নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।

* বিএনপি: দীর্ঘদিন ধরেই তারা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল। এখন তারা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
* আওয়ামী লীগ: শেখ হাসিনা ভারতে নির্বাসিত হলেও দলের কিছু নেতা এখনো দেশে সক্রিয় এবং পুনরায় ক্ষমতায় ফেরার পরিকল্পনা করছে।
* জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য দল: তারা নতুন সরকারের প্রতি আস্থা রাখার পাশাপাশি নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং নতুন সরকার গঠনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহল নানা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।

* ভারত: শেখ হাসিনা তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন। তবে ভারত এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি, বরং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
* চীন ও রাশিয়া: তারা শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন করেছিল, কিন্তু নতুন সরকারের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার কৌশল অনুসরণ করছে।
* যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন: তারা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নতুন সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে এবং অবাধ নির্বাচনের উপর গুরুত্ব দিচ্ছে।

নতুন সরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তা বাস্তবায়ন করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

* একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা গেলে বাংলাদেশ এক নতুন সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যেতে পারবে।
* তবে যদি প্রশাসন ও বিচার বিভাগীয় সংস্কার ব্যর্থ হয়, তাহলে আবারও রাজনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে।
* শেখ হাসিনা ও তার দলের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপও বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে।

শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ও নতুন সরকারের আগমন বাংলাদেশের জন্য এক নতুন অধ্যায় সূচিত করেছে। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রশাসনিক সংস্কার এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নানা চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার যদি স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে, তবে দেশ গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে পারবে। অন্যথায়, এটি আরেকটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সূচনা হতে পারে।


লেখক: আহমেদ শাহেদ 
কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও পেশাদার বাচিক শিল্পী।


নতুন/কাগজ/শাহেদ/মুক্তমত
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন