এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের বক্তব্য ও বাস্তবতা


সম্প্রতি এক আলোচনায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “গণঅভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্য কখনোই ছিল না কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে সরিয়ে আরেকটিকে ক্ষমতায় বসানো। বরং লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় মৌলিক পরিবর্তন, জনঅধিকার প্রতিষ্ঠা এবং শোষণমুক্ত সমাজ গঠন।”
নাহিদ ইসলামের এই বক্তব্য আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গভীর প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়: আমাদের দেশে ঘটে যাওয়া গণআন্দোলনগুলো কি আদৌ কাঠামোগত পরিবর্তনের পথ তৈরি করেছে, নাকি শুধু একদল ক্ষমতাচ্যুত হয়ে আরেকদলের উত্থানের মাধ্যম হয়েছে? ইতিহাস কী বলে?
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, এবং পরবর্তীতে ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সবগুলোর পেছনেই ছিল বৃহত্তর জনগণের অংশগ্রহণ, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই।
তবে বাস্তবতার নিরিখে দেখা যায়, এসব আন্দোলনের ফলাফল প্রায়শই একটি রাজনৈতিক দলকে অপসারণ করে আরেক দলকে ক্ষমতায় বসানোয় পরিণত হয়েছে। কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক সংস্কার, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা কিংবা জবাবদিহিতার ব্যবস্থা খুব কম ক্ষেত্রেই বাস্তবায়িত হয়েছে।
নাহিদ ইসলামের বক্তব্য একটি আদর্শিক অবস্থান। তাঁর মতে, ক্ষমতা নয়, বরং রাষ্ট্রের চেহারা বদলানোই গণআন্দোলনের লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু এ দেশের বাস্তব রাজনীতিতে গণআন্দোলনের ব্যানারে যেসব কর্মসূচি দেখা যায়, তা বেশিরভাগ সময় ক্ষমতাসীন দলের অপসারণ এবং বিরোধী দলের উত্থানের রণকৌশল হয়ে দাঁড়ায়।
এই ধারাবাহিকতা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি অমোঘ বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণ আশাবাদী হয়ে উঠলেও, পরে বারবার হতাশ হয়েছে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের অনুপস্থিতিতে।
এনসিপির মতো বিকল্পধারার দল ও নেতৃত্ব যদি সত্যিই আদর্শভিত্তিক রাজনীতির পক্ষে কথা বলেন, তবে তাদের দায়িত্ব শুধু বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সংগঠন ও মাঠপর্যায়ে তার প্রতিফলন ঘটানো।
নাহিদ ইসলামের মতো নেতৃত্ব যদি বাস্তব রাজনীতিতে জবাবদিহিতা, সুশাসন ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন, তবে জনগণের মনে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির প্রতি আস্থা তৈরি হতে পারে।
নাহিদ ইসলামের বক্তব্য আমাদের ভাবায়—আমরা বারবার কেন আন্দোলনে নামি, আর কেন বারবার কাঠামো অপরিবর্তিত থাকে? গণঅভ্যুত্থান যদি শুধুই ক্ষমতার পালাবদলে রূপ নেয়, তাহলে জনগণের ত্যাগ-তিতিক্ষার কি মূল্য থাকে?
অতএব, সময় এসেছে আমাদের আন্দোলনের গন্তব্য নিয়ে নতুন করে ভাবার। কেবল দলবদলের খেলায় নয়, বরং শাসনব্যবস্থার আমূল সংস্কারে যদি আন্দোলন এগিয়ে যায়, তাহলেই গণতন্ত্র ও জনগণের প্রত্যাশার সত্যিকারের প্রতিফলন ঘটবে।
