লোকসানের অজুহাতে সম্ভাবনার ট্রেন থেমে যেতে পারে না


বাংলাদেশের কৃষি, অর্থনীতি ও গ্রামীণ জীবনের বিকাশে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিশেষ করে কৃষিপণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে পরিবহন খরচ কমানো মানে হলো, কৃষকের আয় বাড়ানো এবং ভোক্তার জন্য খাদ্য আরও সাশ্রয়ী করা। এই চিন্তা থেকেই পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে চালু করেছিল ‘ম্যাংগো স্পেশাল’ ও ‘ক্যাটল স্পেশাল’ ট্রেন — যা শুধু একটিমাত্র পরিবহন সেবা নয়, বরং এটি ছিল একটি রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা, একটি কৃষি বান্ধব উদ্যোগ।
কিন্তু এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, মাত্র অর্ধকোটি টাকার লোকসানকে কেন্দ্র করে এই জনমুখী উদ্যোগ বন্ধের পথে। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম রাজধানীখ্যাত অঞ্চল। এখানকার কৃষকরা আম উৎপাদন করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠান। পাঁচ বছর ধরে ১.৪৫ টাকা কেজি ভাড়ায় এই আম ট্রেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল — যা রাস্তাঘাটের তুলনায় অনেক নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও সময়োচিত। একইভাবে, ঈদুল আজহাকে ঘিরে কোরবানির পশু পরিবহনে ‘ক্যাটল স্পেশাল’ ট্রেন খামারিদের জন্য ছিল একটি বড় সহায়ক শক্তি। কিন্তু এবার সেই ট্রেন আর চালানো সম্ভব নয় — কারণ এটি লোকসানি!
রেলওয়ের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে আয় হয়েছে প্রায় ৪৮ লাখ টাকা, আর খরচ হয়েছে ৯২ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রায় ৪৫ লাখ টাকা লোকসান, যা রেল কর্মকর্তাদের ভাষায় "অর্থনৈতিকভাবে টেকসই নয়"।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কি শুধুই মুনাফার জন্য পরিচালিত হয়? সব সেবামূলক উদ্যোগে কি লাভই একমাত্র বিবেচ্য হবে?
আমরা ভুলে যাচ্ছি, এই প্রকল্পে ক্ষতি হলেও এর বহুমাত্রিক সুবিধা ছিল:
* কৃষকের আয় বেড়েছে কারণ পরিবহন খরচ কমেছে।
* পথে পঁচে যাওয়া আম কমেছে, যেহেতু ট্রেন অপেক্ষাকৃত দ্রুত ও নিরাপদ।
* সড়কজুড়ে যানজট কমেছে, কারণ প্রচুর পণ্য ট্রেনে পরিবাহিত হয়েছে।
* নগর ও গ্রাম সংযুক্তির একটি কার্যকর মডেল তৈরি হয়েছে, যা ভবিষ্যতের জন্য উদাহরণ হতে পারত।
লোকসানের কারণ ব্যর্থ পরিকল্পনা, না কি অংশীদারদের অনাগ্রহ?
রেল কর্তৃপক্ষ বলছেন, আম পরিবহনে চাষি ও ব্যবসায়ীদের আগ্রহ নেই। কিন্তু সেই আগ্রহ তৈরির দায়িত্ব কি কেবল কৃষকের? ট্রেনের সময়সূচি, বুকিং ব্যবস্থা, তথ্য প্রচার — এসব কতটা কৃষকবান্ধব ছিল? অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, ট্রেন বুকিং জটিল, সময় অজানা, প্রচার নেই, ফলে কৃষক ট্রাক বা পিকআপকেই ভরসা করেছেন।
অপরদিকে, ঢাকা যাওয়ার আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর লাগেজ ভ্যানে আম পাঠাতে বলছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এসব ভ্যানে কি ফল সংরক্ষণের মতো পর্যাপ্ত শীতলীকরণ বা নিরাপত্তা আছে? পশু বা ফল — কোনো সংবেদনশীল কৃষিপণ্যই সেখানে পরিবহনের আদর্শ পরিবেশ পায় না।
বিকল্প না খুঁজেই ‘বন্ধ’ ঘোষণা উন্নয়ন নয়
এই ট্রেন বন্ধ হওয়ার মানে শুধু একটি প্রকল্পের মৃত্যু নয় — এটা গ্রামীণ উন্নয়ন দর্শনের একটি পরাজয়। এই উদ্যোগকে আরও লাভজনক, আরও কার্যকর করার রাস্তা ছিল:
* অনলাইন ও অ্যাপে সহজ বুকিং
* কৃষি বিভাগের সঙ্গে সমন্বয়ে তথ্য প্রচার
* বেসরকারি অংশীদারিত্বে মালবাহী সেবা
* ট্রেনের সময় নির্ধারণ কৃষকের সুবিধামতো
* পণ্য সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতি সংযুক্তি
সরকারি সহযোগিতা ছাড়া গ্রামীণ অর্থনীতি টেকসই হয় না। এই ট্রেন প্রকল্পটিকে লোকসান বলে বন্ধ করে দেওয়ার অর্থ—রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষককে আরও একবার শহরের দরজায় অপেক্ষমাণ করে রাখা।
শেষ কথা একটি রাষ্ট্রের লক্ষ্য কেবল মুনাফা নয়, বরং জনকল্যাণ। রেল যেমন একটি পরিবহন ব্যবস্থা, তেমনি এটি হতে পারে কৃষি সহায়তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ম্যাংগো ও ক্যাটল স্পেশাল ট্রেনকে লোকসানের অজুহাতে থামিয়ে দেওয়া নয়, বরং তা আরও কীভাবে লাভজনক ও টেকসই করা যায়, সেই চিন্তা থাকা উচিত।
এটি থামলে ক্ষতি শুধু রেলের নয়, ক্ষতি পুরো একটি সম্ভাবনাময় বিকেন্দ্রীকৃত কৃষি অর্থনীতির।
