বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
Natun Kagoj

তৈন খালের বর্ষার রূপ আপনাকে মুগ্ধ করবেই

তৈন খালের বর্ষার রূপ আপনাকে মুগ্ধ করবেই
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

বর্ষা নামলেই পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে এক অদ্ভুত শব্দ জাগে। কল কল কল জলের শব্দ। সেই শব্দ অনুসরণ করলেই পৌঁছে যাওয়া যায় এক ভয়ংকর সৌন্দর্যের আখড়ায়, যার নাম তৈন খাল। বান্দরবানের আলীকদমের গভীরে অবস্থিত এ খাল যেন পুরোনো পাহাড়ি উপন্যাসের চরিত্র। যার বুক চিরে বয়ে চলে শত গল্পের ঢেউ। এ খাল কেবল জলপথ নয় বরং জীবন্ত প্রকৃতির এক নিঃশব্দ ভাষ্য। যেখানে জলের গতি, পাখির ডাক, পাতার কাঁপন আর পাহাড়ি বাতাস একসঙ্গে মিলে সৃষ্টি হয় মায়াবী দৃশ্যপট।

বর্ষায় তৈন খালের রূপ দেখে যেন মনে হয়, আমাজন নদীর‌ই কোনো অংশ এসে ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশের গহীন কোণে। পাহাড়ি ঢল নেমে আসে সোজা খালের বুকে। তখন তার পানির রং হয় ঘন সবুজ-নীল। দুই পাশের পাহাড় ঢেকে যায় কুয়াশা আর মেঘে। মাঝে মাঝে রোদের ঝলক খেলতে থাকে পাতার গায়ে। পানির স্রোত এতটাই প্রবল হয় যে, খাল হয়ে ওঠে ভাসমান বনভূমি। যার বুক চিরে এগিয়ে চলে সরু নৌকা, কখনো বাঁশের ভেলা। মনে হয়, যেন কোনো অজানা অভিযানে বেরিয়েছেন। প্রতিটি বাঁকেই লুকিয়ে আছে নতুন কোনো রহস্য।

তৈন খাল শুধু সৌন্দর্যেই সেরা নয় বরং এটি ঘিরে আছে এক জৈব-সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। খালপাড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ম্রো, মারমা ও অন্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের ঘর-বাড়ি যেন স্থানকে আরও বেশি প্রাণবন্ত করে তোলে। তাদের জীবনযাত্রা, ভাষা ও চালচলনে মিশে আছে প্রকৃতির ছন্দ। বর্ষাকালে যখন পর্যটকরা আসেন; তখন স্থানীয়রা তাদের স্বাগত জানান একরাশ হাসি আর ভিন্ন স্বাদের খাবারের ঘ্রাণে। খালের খুব কাছেই গড়ে ওঠা ছোট বাজার, যেটি পরিচিত ‘দুসরী বাজার’ নামে। সেখানে বিক্রি হয় খালের দেশি মাছ, পাহাড়ি মধু, বাঁশের তৈরি হস্তশিল্প আর আদিবাসীদের জুম সবজি, স্থানীয় খাবার।

বর্ষাকালে আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঝিরিপথ, যেমন- থাঙ্কুয়াইন ঝিরি, পালংখিয়াং ঝিরি কিংবা লাদমেরাগ জলপ্রপাত; তৈন খালের সৌন্দর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। প্রতিটি ঝিরি বর্ষায় হয়ে ওঠে বুনো ও রোমাঞ্চকর। আবার শুষ্ক মৌসুমে শান্ত ও স্বচ্ছ। চিন্তা করলে, এখানের প্রকৃতি যেন প্রতি মৌসুমে তার মেজাজ বদলায়। কেউ যদি হাঁটতে ভালোবাসেন, তবে ঝিরিপথ ধরে এগিয়ে গেলে পাবেন সাদা পাথরে গড়া প্রাকৃতিক পুল, শীতল জলে ডুবে থাকা একান্ত মুহূর্ত আর প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানো শৈশব স্মৃতি।

এই স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মাঝে কিছু দায়িত্বও এসে পড়ে আমাদের কাঁধে। তৈন খালের পরিবেশ আজও প্রায় অক্ষত। কারণ এখানকার মানুষের প্রকৃতি প্রেম আর অল্প ভ্রমণ চাপ। কিন্তু পর্যটনের প্রসারে যে হুমকি আসছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা, উঁচু শব্দে গান বাজানো বা স্থানীয়দের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক ব্যবহার। এসব থেকে বিরত না থাকলে একদিন এ ‘ভয়ংকর সুন্দর’ ম্লান হয়ে যাবে।

বর্ষায় যখন আপনি তৈন খাল দেখতে যাবেন, মনে রাখবেন আপনি কেবল প্রকৃতি দেখছেন না বরং প্রকৃতির এক অভিজ্ঞান পেয়ে যাচ্ছেন। হেঁটে চলুন ঝিরিপথে, নৌকা বেয়ে প্রবেশ করুন গাছের ছায়াঘেরা খালের গহীনে, দাঁড়িয়ে থাকুন কোনো এক উঁচু পাথরের ওপর। যেখান থেকে দেখা যায় পুরো খালের বিস্তার, শুনতে পাওয়া যায় জলের গান।

তৈন খাল কোনো প্রচারিত বা বানানো ট্যুরিস্ট স্পট নয়। এটি এক জীবন্ত চিত্রকর্ম! যার রূপ বর্ষায় উন্মুক্ত হয় ঘোমটা সরিয়ে। এখানে এলে আপনি খুঁজে পাবেন প্রকৃতির কাছে নিজের ক্ষুদ্রতা আর সেই অনুভবটাই আপনাকে বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যাবে তৈন খালের বুকে।

তৈন খাল ভ্রমণে যেতে চাইলে প্রথমে যেতে হবে বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায়। ঢাকা থেকে শ্যামলী ও হানিফ পরিবহন বাস সরাসরি সেখানে যাতায়াত করে। এ ছাড়া ঢাকা থেকে কক্সবাজারগামী বাসগুলোতে ভ্রমণ করলে আপনি নামতে পারবেন চকরিয়া। চকরিয়ায় নেমেও চান্দের গাড়িতে করে যেতে পারেন আলীকদম। চান্দের গাড়ি করে যেতে পারবেন দুসরী বাজার পর্যন্ত‌ও। এখান থেকে তৈন খাল বেশি দূরে নয়। স্থানীয় গাইডের মাধ্যমে সহজেই পৌঁছে যাবেন এ খালে।

তবে বিভিন্ন ট্যুর গাইডের সঙ্গে গেলে তৈন খালের পাশাপাশি দেখতে পাবেন বেশ কয়েকটি জলপ্রপাত। ছয় থেকে আট হাজার টাকা খরচেই তৈন খালের সঙ্গে দেখে আসতে পারবেন থাঙ্কুয়াইন ঝিরি, পালংখিয়াং ঝিরি, লাদমেরাগ জলপ্রপাত, নারিশ্যা ঝিরি, জামরুল ঝরনা ইত্যাদি। তবে যে কোনো দুর্ঘটনা এড়াতে ভ্রমণ বিধিমালা অনুসরণ করতে হবে।

এ রোমাঞ্চকর ভ্রমণে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। জেনে নিতে হবে ভ্রমণের জন্য উন্মুক্ত কি না। কেননা দুর্গম পথ, সীমিত সুযোগ-সুবিধা ও বর্ষার আবহাওয়া পরিবর্তন নতুন কিছু নয়। শারীরিকভাবে ফিট থাকা জরুরি, সাঁতার জানা থাকলে সবচেয়ে ভালো। সঙ্গে নিতে হবে ট্রেকিং জুতা, শুকনো খাবার, পানির বোতল, ওষুধ, রেইন কোট, টর্চলাইট, পাওয়ার ব্যাংক এবং পলি। তবেই সবার যাত্রা সুন্দর হয়ে উঠবে।


দৈএনকে/জে .আ
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

সর্বশেষ