চুমুতে সংস্কৃতির ছাপ: কোন দেশে কেমন রীতি?


চুমু, একটি ছোট্ট স্পর্শ, অথচ এর ব্যপ্তি বিস্তৃত ইতিহাস, আবেগ, সংস্কৃতি আর কূটনীতিতেও। বিশ্বজুড়ে ‘চুমু’ কখনো প্রেমের ভাষা, কখনো বন্ধুত্বের বন্ধন, আবার কোথাও তা সামাজিক ট্যাবু। একই কাজ ঠোঁট ছোঁয়ানো বিভিন্ন দেশে এতটা ভিন্ন অর্থ বহন করে, তা জানলে আপনি হয়তো অবাক হবেন।
একটি চুমু, যা আপনি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে নেন, অন্য দেশে তা বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। তাই ভ্রমণ কিংবা আন্তঃসাংস্কৃতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এসব রীতিনীতির প্রতি সম্মান দেখানো ও বোঝা জরুরি। চুমু শুধু আবেগ নয়, এটি সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ।
আসুন জানা যাক পৃথিবীর নানা প্রান্তে চুমুর ধরন, নিয়ম আর প্রতীকী অর্থ কী-
পশ্চিমা বিশ্ব: প্রেম, বন্ধুত্ব ও সামাজিক ভদ্রতা
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা
এখানে চুমু প্রধানত রোমান্টিক সম্পর্কে ব্যবহৃত হলেও, হালকা গালে চুমু বা চিবুকে চুমু (peck) বন্ধু বা আত্মীয়দের মধ্যেও স্বাভাবিক। পাবলিক ডিসপ্লে অব অ্যাফেকশন-যেমন রাস্তায় হালকা চুমু সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য।
ফ্রান্স
ফরাসিরা চুমুর জন্য বিখ্যাত। তবে শুধু রোমান্টিক অর্থে নয়। তাদের রয়েছে চুমুর এক রীতি, যার নাম ‘লা বিসা’। এই রীতি অনুযায়ী দেখা হলে বন্ধুর গালে এক বা একাধিক চুমু (দুই, তিন বা চারটি পর্যন্ত, অঞ্চলভেদে) দেওয়া হয়ে থাকে। এটি সামাজিক সম্ভাষণ।
ইটালি, স্পেন, পর্তুগাল
দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোতেও দুই গালে চুমু জনপ্রিয় সম্ভাষণ পদ্ধতি। তবে এটি অনেক সময় অপরিচিতদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়ে থাকে।
লাতিন আমেরিকা: উষ্ণতার চুমু
আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, মেক্সিকো
চুমু এখানে বন্ধুত্বের চিহ্ন। একজন পুরুষ অন্য পুরুষকে কপালে বা গালে চুমু দিতেও সংকোচবোধ করে না। ব্রাজিলে এক গাল বা দুই গালে চুমু দৈনন্দিন সম্ভাষণ হিসেবে প্রচলিত। এটি কোনো রোমান্টিক ইঙ্গিত নয় বরং ভালোবাসার পরিবেশ সৃষ্টির ইঙ্গিত।
এশিয়া: মিশ্র সংস্কৃতি ও সংযত প্রকাশ
জাপান
জাপানে চুমু ব্যক্তিগত বিষয়ের মধ্যে পড়ে। পাবলিক চুমু বিরল ও অনেকক্ষেত্রে সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। তবে ব্যক্তিগত জীবনে রোমান্সে চুমু গুরুত্বপূর্ণ।
চীন
চীনেও জনসম্মুখে চুমু কিছুটা ট্যাবু হলেও, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ধীরে ধীরে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। তবে এখনঘ বয়স্কদের কাছে এটি ‘অশালীন’ বলে বিবেচিত হতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়া
চুমু টিভি নাটকে বা মিউজিক ভিডিওতে প্রকাশ পায়, কিন্তু বাস্তবে পাবলিক ডিসপ্লে অব অ্যাফেকশন অনেক সীমিত। একান্ত রোমান্টিক সম্পর্কের মধ্যেই চুমু সীমাবদ্ধ।
ভারত
ভারতে প্রকাশ্যে চুমু এখনো অনেক জায়গায় আইনগতভাবে নিষিদ্ধ বা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তবে শহরভিত্তিক তরুণ সমাজে এটি বাড়ছে। বলিউড সিনেমায় চুমু দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ ছিল, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি বদলাচ্ছে।
বাংলাদেশ
বাংলাদেশে চুমু খুবই ব্যক্তিগত এবং সামাজিকভাবে সংবেদনশীল বিষয়। রোমান্টিক চুমু প্রকাশ্যে গ্রহণযোগ্য নয়। তবে শিশুকে কপালে বা গালে চুমু দেওয়া স্নেহের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে স্বাভাবিকভাবে দেখা হয়।
সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত
চুমু শুধু বৈবাহিক বা ঘরোয়া সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ। পাবলিক চুমু, এমনকি হাত ধরা অনেক জায়গায় আইনগত শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে পুরুষ বন্ধুরা একে অপরকে কপালে চুমু দিতে পারেন, যা ‘সম্মান’ বা ‘ভ্রাতৃত্বের’ প্রতীক।
ইরান
ইরানে প্রকাশ্যে রোমান্টিক চুমু নিষিদ্ধ হলেও, একই লিঙ্গের মানুষের মধ্যে সম্ভাষণমূলক চুমু (যেমন গালে চুমু) সামাজিকভাবে স্বীকৃত।
উত্তর ও মধ্য এশিয়া: সামাজিকতা ও সম্ভাষণে চুমু
গালে চুমু সম্ভাষণের অংশ, তবে পুরুষেরা অনেক সময় একে অপরের ঠোঁটেও চুমু দেন যাকে বলা হয় ‘ব্রাটস্কি পোটসেলুই’ বা ‘ভাইয়ের চুমু’। এটা স্নেহ ও রাজনৈতিক কূটনীতিতেও ব্যবহৃত (যেমন সোভিয়েত যুগে লিওনিদ ব্রেজনেভ এবং এরিখ হোনেকারের ঐতিহাসিক ‘সোশ্যালিস্ট চুমু’)।
আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া: ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি
আফ্রিকার গ্রামীণ সমাজ
অনেক আফ্রিকান উপজাতি ও গ্রামাঞ্চলে চুমুর ধারণা অপ্রচলিত। তারা নাক ঘষে (যেমন ইনুইটদের মতো) বা হাত স্পর্শে আন্তরিকতা প্রকাশ করেন।
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী সংস্কৃতি
এখানে চুমু আধুনিক সংস্কৃতির প্রভাবেই এসেছে। আদিবাসী সমাজে এটি খুব বেশি প্রচলিত ছিল না।
ইনুইট ও মাওরি (নিউজিল্যান্ড): ইনুইটরা আর্কটিক অঞ্চলের অধিবাসী। তাদের মধ্যে ‘এসকিমো কিস’ নামে পরিচিত একটি রীতি রয়েছে, যেখানে দুজন ব্যক্তি নাক ঘষে ঘনিষ্ঠতা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে নিউজিল্যান্ডের মাওরি জনগোষ্ঠীদের রয়েছে ‘হংগি’ নামের নাকের চুমুর এক রীতি। ‘হংগি’ নামক সম্ভাষণে কপাল ও নাক একত্রে ঠেকানো হয়। এটি আত্মিক সংযোগের প্রতীক।
দৈএনকে/জে .আ
