বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
Natun Kagoj

ভানুনু: ইসরায়েলের পারমাণবিক রহস্যভেদের নায়ক?

ভানুনু: ইসরায়েলের পারমাণবিক রহস্যভেদের নায়ক?
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

ইসরায়েলের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে—এটা কয়েক দশক ধরেই আন্তর্জাতিকভাবে জানা থাকলেও দেশটি কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি স্বীকার করেনি। ১৯৬০-এর দশক থেকে শুরু হওয়া পারমাণবিক সক্ষমতা নিয়ে বরাবরই নীরব থেকেছে তেলআভিভ।

সম্প্রতি, ইসরায়েল দাবি করেছে যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সেই দাবি ঘিরেই শুরু হয়েছে নতুন উত্তেজনা। প্রায় এক সপ্তাহ আগে ইরানের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালায় ইসরায়েল। পাল্টা জবাব হিসেবে ইরানও একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুর দিকে।

উভয় দেশের মধ্যে এই পাল্টাপাল্টি হামলায় গোটা মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের শঙ্কা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, দুই দেশই এখন এমন এক উত্তপ্ত অবস্থানে রয়েছে, যেখানে কূটনৈতিক সমাধান যত এগিয়ে আসছে, সামরিক সংঘর্ষের সম্ভাবনাও ততই জোরালো হয়ে উঠছে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চললেও এখনো পর্যন্ত কোনো পক্ষই সরে আসার ইঙ্গিত দেয়নি। সংঘাতের এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে তা গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকিতে পরিণত হতে পারে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইরানসহ অন্যান্য দেশগুলো পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে (এনপিটি) স্বাক্ষর করলেও ইসরাইল এখন পর্যন্ত সই করেনি।

ফলে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মতো একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর আইএইএ-কে তাদের সম্ভাব্য পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করতে দিতে তারা বাধ্য নয়। যদিও ইসরাইল নিজে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার একজন সদস্য।

যেহেতু দেশটি পরিদর্শনের অনুমতি দেয় না, সেকারণে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে খুব একটা তথ্যও পাওয়া যায় না।

যতটুকু তথ্য জানা যায়, সেগুলো মূলত ফাঁস হওয়া তথ্য, মার্কিন প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি বিভাগের প্রতিবেদন এবং পারমাণবিক কর্মসূচি পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর গবেষণা থেকে প্রাপ্ত।

এছাড়াও ইসরাইলের সাবেক পরমাণু প্রকৌশলী মোর্দেচাই ভানুনুর সাক্ষাৎকার থেকেও দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে একটা ধারণা পাওয়া যায়।

এক সময় ইসরাইলি পারমাণবিক কেন্দ্রে কর্মরত ভানুনু-কে গত শতাব্দীর আশির দশকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। পরে ১৯৮৬ সালে তিনি ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য সানডে টাইমসের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন।

ওই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমেই ভানুনু তখন বিশ্ববাসীকে জানিয়েছিলেন যে, ইসরাইলের পারমাণবিক কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। এই তথ্য প্রকাশ করার জন্য তাকে অনেক বছর জেলও খাটতে হয়েছে।

পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে তথ্য প্রকাশিত হলেও ইসরাইলের নেতারা নিজ মুখে কখনও সেটি স্বীকার করেননি, আবার অস্বীকারও করতে দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে তারা বরং অস্পষ্টতা রাখার নীতি মেনে চলেন।

পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়ে ইসরাইলের সরকারের এই নীতিকে বলা হয় ‘আমিমুত’, যার অর্থ দাঁড়ায় ‘ইচ্ছাকৃত অস্পষ্টতা’।

যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডসে জমা দেওয়া এক প্রতিবেদনে ইসরাইলের পারমাণবিক কর্মসূচি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অ্যাভনার কোহেন উল্লেখ করেছেন, ইসরাইলের পারমাণবিক যুগে এই নীতিটি সম্ভবতঃ তাদের সবচেয়ে স্বতন্ত্র ব্যাপার। 

যদিও ইসরাইলের ইতিহাসে এই নীতি মোটেও নতুন কিছু নয়। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি শিমন পেরেজ তার আত্মজীবনীতেও বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।

পরমাণু কর্মসূচি সামনে এসেছিল যেভাবে

ইসরাইলের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে প্রথমবার তথ্য জানা যায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ১৯৬২ সালের একটি নথি থেকে।

গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে দক্ষিণ ইসরাইলে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে ফ্রান্স ও ইসরাইলের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল বলে ওই নথিতে বলা হয়।

ডেলাস সেন্টার ফর পিস স্টাডিজের গবেষক জেভিয়ার বোহিগাস বলছেন, ফ্রান্সের সঙ্গে ওই চুক্তির লক্ষ্য ছিল প্লুটোনিয়াম অর্জনের জন্য একটি চুল্লি তৈরি করা।

গুগল ম্যাপে শহরটির অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, নেগেভ নিউক্লিয়ার রিসার্চ সেন্টার নামের ওই পরমাণু গবেষক কেন্দ্রটি ডিমোনা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে একটি মরুভূমির মাঝখানে অবস্থিত।

প্রথমদিকে ওই স্থাপনাটিকে বস্ত্রশিল্পের কারখানা এবং কৃষি ও ধাতুবিদ্যা সংক্রান্ত গবেষণা কেন্দ্র হিসাবে বর্ণনা করেছিল ইসরাইল। পরবর্তীতে ষাটের দশকে এসে ইসরাইলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়টি প্রথমবার স্বীকার করেন।

দেশটির পার্লামেন্টে দেওয়া এক ভাষণে পারমাণু গবেষণা কেন্দ্রটির উদ্দেশ্য শান্তিপূর্ণ ছিল বলে দাবি করেন।

বোহিগাস বলেন, কিন্তু মার্কিন প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদন থেকে এটা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, ইসরায়েলের একটি পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রকাশিত গোপন নথি থেকে জানা যায়, ১৯৭৫ সালের মধ্যেই দেশটির সরকার নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, ইসরাইলের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। এরপর আশির দশকে এসে পরমাণু প্রকৌশলী মোর্দেচাই ভানুনু ইসরাইল সরকারের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয় আবারও সামনে আনেন।

সানডে টাইমসের কাছে অভিযোগ

ইসরাইলি পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে আরও বিস্তারিতভাবে জানা যায় গত শতাব্দীর আশির দশকে ব্রিটিশ গণমাধ্যম সানডে টাইমসে প্রকাশিত ইসরাইলি পরমাণু প্রকৌশলী মোর্দেচাই ভানুনুর সাক্ষাৎকার থেকে।

ভানুনু ১৯৮৫ সালে চাকরিচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় নয় বছর যাবত ইসরায়েলের ডিমোনা পারমাণবিক কেন্দ্রে কাজ করেন। ওই নয় বছরে তিনি গোপনে স্থাপনাটির বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার বেশ কিছু ছবি তোলেন।

সেই ছবিতে দেখা যায়, কেন্দ্রটিতে পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিষ্কাশনের সরঞ্জাম এবং পরীক্ষাগার দেখা যায়।

ভানুনু ১৯৮৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে পরমাণু অস্ত্রবিরোধী একটি সম্মেলনে অংশ নেন। সেখানেই কলম্বিয়ার ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক অস্কার গুয়েরেরোর সঙ্গে তার দেখা হয়। গুয়েরেরোই তাকে ইসরাইলি পরমাণু কেন্দ্রের ছবিগুলো প্রকাশে রাজি করাতে সক্ষম হন।

এরপর ভানুনু ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য সানডে টাইমসের সাংবাদিক পিটার হাউনামের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

এ বিষয়ে হাউনাম বিবিসির ‘উইটনেস হিস্ট্রি’ অনুষ্ঠানকে বলেন, বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর ইসরাইল তার পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়বে বলে বিশ্বাস করতেন ভানুনু। যদিও বাস্তবে তেমন কিছুই ঘটেনি।

উইটনেস হিস্ট্রিতে প্রচারিত তথ্য থেকে জানা যায় যে, সাক্ষাৎকার প্রচারের পর ভানুনুকে মাদক সেবন করানোর পর অপহরণ করে ইসরাইলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে রাষ্ট্রদ্রোহ ও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে তাকে ১৮ বছরের কারাদণ্ড দেয় ইসরাইল। তবে ভানুনু অবশ্য তাতে দমে যাননি।

দীর্ঘদিন কারাভোগের পর ২০০৪ সালে মুক্তি পান তিনি। তখন ভানুনু বলেছিলেন যে, অতীতের ভূমিকার জন্য তিনি মোটেও অনুতপ্ত নন, বরং গর্বিত এবং খুশি এ ঘটনার পর তাকে আবারও সাজা দেওয়া হয়।

বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং ইসরাইল ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে তার ওপর। এই মোর্দেচাই ভানুনুর কল্যাণেই ইসরাইলের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কর্মসূচি সম্পর্কে বিশ্ববাসী নিশ্চিত হয়েছিল।

ঠিক কতগুলো বোমা আছে?

১৯৮৬ সালে ভানুনু জানিয়েছিলেন যে, ওই সময় ইসরাইলের কাছে আনুমানিক ১০০ থেকে ২০০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড ছিল।

বোমার সামনের যে অংশে মূলত বিস্ফোরক রাখা থাকে, সেটি ওয়ারহেড নামে পরিচিত। ভানুনু কয়েকশ ওয়ারহেড থাকার দাবি করলেও পরমাণু অস্ত্র পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলো অবশ্য তা বলছে না।

সুইডেনভিত্তিক পরমাণু অস্ত্র পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, বর্তমানে ইসরাইলের কাছে ৯০টির মতো ওয়ারহেড থাকতে পারে।

এসব ওয়ারহেড তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় প্লুটোনিয়াম দক্ষিণ ইসরাইলের ডিমোনা শহরের কাছে অবস্থিত নেগেভ পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রের চুল্লিতে উৎপাদিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

যদিও ইসরাইলের সরকার দাবি করে আসছে যে, পরমাণু চুল্লিটির উৎপাদন সক্ষমতা মাত্র ২৬ মেগাওয়াট। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন যে, চুল্লিটির উৎপাদন সক্ষমতা আরও অনেক বেশি।

ইসরাইলের অন্যান্য পারমাণবিক স্থাপনার মতো এই চুল্লিটিরও আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) নজরদারির বাইরে রয়েছে। ফলে সেটির অপব্যবহার হচ্ছে কী-না এবং পারমাণবিক কর্মসূচি কতটা শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটি স্বাধীনভাবে যাচাই করার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে ইসরাইল যদি তথ্য না দেয়, তাহলে কীভাবে জানা যাবে যে, দেশটির কাছে কতগুলো পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে?

যদিও পদ্ধতিটি আগেও বিভিন্ন সময় ব্যবহৃত হয়েছে। ইসরাইলের মতো উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রেই একই পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেশটির ‘পারমাণবিক ওয়ারহেড’ সম্পর্কে একটা ধারণা পেয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। উত্তর কোরিয়ার কাছে প্রায় ৫০টি ওয়ারহেড রয়েছে বলে অনুমান করেন তারা।

বোহিগাস জানান যে, ২০১১ সালে নিউ স্টার্ট ট্রিটি স্বাক্ষরের আগে যখন পরমাণু স্থাপনাগুলো পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ বাধ্যতামূলক ছিল না, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে থাকা পারমাণিক বোমার সংখ্যার বিষয়ে আনুমানিক একটা ধারণা পেয়েছিল পরমাণু পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলো। পরে তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর দেখা গেছে, সেগুলো বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ।
 


গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

সর্বশেষ