ম্যাডাম বলছিলেন ‘দৌড়াও’ ভয় পেও না, আমি আছি


শিক্ষক জাতি গঠনের কারিগর -এই কথার সত্যতা যেন নিজ জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন মেহরিন চৌধুরী। সোমবার (২১ জুলাই) প্রতিদিনের মতো স্কুল শেষ করে শিশুদের হাতে ধরে গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছিলেন তিনি।
রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ২০ শিক্ষার্থীকে প্রাণে বাঁচিয়ে নিজেই চিরবিদায় নিলেন বীর শিক্ষিকা মেহরিন চৌধুরী। তিনি ছিলেন নীলফামারীর জলঢাকা পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বগুলাগাড়ি চৌধুরীপাড়া মরহুম মুহিত চৌধুরী মেয়ে।
মেহরিন রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা ভার্সনের কো-অর্ডিনেটর (তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি) ছিলেন।
এলাকাবাসীরা জানান, সম্প্রতি তিনি নিজ গ্রামের বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজকে মাইলস্টোনের মতো গড়ে তোলার স্বপ্নে এক মাস আগে ওই স্কুলের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এমনটাই জানিয়েছেন তার স্বামী মনসুর হেলাল। স্ত্রীকে হারিয়ে তিনি শোকে পাথর। তিনি বলেন জলঢাকার বগুলাগাড়ি চৌধুরীপাড়ায় বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হবে।
মেহরিন চৌধুরীর মৃত্যু সংবাদ মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে শোক, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ভরা স্ট্যাটাস।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নীলফামারী জেলা কমিটির আহবায়ক মো: সেলিম ফারুক, বলেন বিশজন শিশুকে বাঁচিয়ে আজ মেহরিন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে । তার দগ্ধ শরীর হয়তো যন্ত্রণায় কাতর ছিল , কিন্তু তার আত্মা যে কতটা শক্তিশালী, তা তার এই মহৎ কর্মই প্রমাণ করে। আমরা তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। সেলিম ফারুক, বলেন মাহরীন চৌধুরীর পারিবারিক পরিচয়ও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাতিজি। মাহেরীন চৌধুরীর বাবার নাম মহিতুর রহমান চৌধুরী ও মা সাবেরা চৌধুরী। মাহরীনের দাদি রওশানারা চৌধুরী ছিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের খালা।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নীলফামারী জেলা কমিটির যুগ্ন আহবায়ক মোস্তফা প্রধান বাচ্চু বলেন, যখন আগুনের লেলিহান শিখা আর ধ্বংসের বিভীষিকা গ্রাস করছিল স্কুল প্রাঙ্গণ, তখন মেহেরিন তার নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শিশুদের বাঁচাতে। প্রায় ৮০ শতাংশ দগ্ধ শরীর নিয়েও সে মরনপণ লড়াই করেছে, অন্তত ২০ জন অবুঝ শিশুকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছে। তার এই অদম্য সাহস, এই আত্মত্যাগ, এই মানবতাবোধ সত্যিই বিরল। সে কেবল একজন শিক্ষিকা না, একজন সত্যিকারের মানুষ ছিল ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুর্ঘটনার পরপরই ক্লাসরুম থেকে শিক্ষার্থীদের দ্রুত বের করে দেন মেহরিন। এক সেনা সদস্য বলেন, “ম্যাডাম ভিতরে ঢুকে গিয়ে বাচ্চাগুলারে বের করে দিছেন, তারপর উনিই আর বের হতে পারেন নাই।”
উদ্ধার হওয়া শিক্ষার্থী ছোয়ার বাবা সুমন বলেন, “ম্যাডাম না থাকলে আমাদের ছোয়া বাঁচত না।”
ছোয়ার মামা জানান, “আমি খালি ওর চুল পড়ে থাকতে দেখেছি, পরে জানতে পারি এক ম্যাডাম ওকে বের করে আনেন।”
একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছে— “ম্যাডাম বলছিলেন, ‘দৌড়াও, ভয় পেও না, আমি আছি।’”
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, শিক্ষিকা মেহরিনের সাহসিকতায় অন্তত ২০ শিক্ষার্থীর প্রাণ রক্ষা সম্ভব হয়েছে। মানবিকতা, সাহসিকতা ও দায়িত্বশীলতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবেন তিনি।
