এমন ভয়ের পরিবেশে রায় কে দেবে: সারা হোসেন


জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর অতিক্রম করলেও দেশের বিচারব্যবস্থার ভেতরে এখনো ভয়ের পরিবেশ বিদ্যমান বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন।
সারা হোসেন বলেছেন, ‘বাংলাদেশে এখন কোনো ভয়ভীতি নেই, এমনটা কেউই বলতে পারবে না। ভয় বিচারব্যবস্থার ভেতরেও আছে, বাইরেও আছে। বিচারপতিদের সবারই চিন্তা হচ্ছে, আমি কী করলে, কে আমার বিরুদ্ধে কথা বলবে। কোনো একটা গোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে কিছু একটা নিয়ে জোরে আওয়াজ তুললেই তো শেষ। সে বিচারপতির আর কোনো ভবিষ্যৎই থাকবে না। এমন ভয়ের পরিবেশে কে ঠিকমতো রায় দেবে বলুন? রায় তো দূরের কথা, আদেশই–বা কে দেবে?’
আজ বুধবার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে এক গোলটেবিল বৈঠকে আইনজীবী সারা হোসেন এ কথাগুলো বলেন। ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: এক বছরের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এই গোলটেবিলের আয়োজন করেছে প্রথম আলো। গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ।
গোলটেবিল বৈঠকের শুরুতে রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনায় শোক জানানো হয়। সবাই এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করেন।
বৈঠকে সারা হোসেন বলেন, ‘গত এক বছরে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা নিয়ে অনেক কথা হলেও এর কাঠামোতে এমন কোনো পরিবর্তন আসেনি, যেটা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। প্রাথমিকভাবে যেসব পরিবর্তন এসেছে, সেগুলো ঠিক ছিল কি না, সেসব নিয়ে আরও আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। হাইকোর্টের বিচারকদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে কেন? সেসব কারণ আমরা আজও জানি না। এগুলো নিয়ে কথাও বলা যাচ্ছে না। এ নিয়ে পত্রিকাগুলোও বেশি কিছু লেখার চেষ্টা করছে না।’
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: এক বছরের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিলে আলোচকেরা। আজ বুধবার সকালেরাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: এক বছরের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিলে আলোচকেরা। আজ বুধবার সকালে। ছবি: সংগৃহীত
জুলাই-আগস্ট পরবর্তী সময়ে সারা দেশে গণহারে করা ঢালাও মামলার বিষয়ে সারা হোসেন বলেন, ‘মামলায় লাখ লাখ নাম দেওয়া হয়েছে। সেগুলো ঠিক কি না, সেটা স্বাধীনভাবে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। ঢালাও মামলা সাংঘাতিক লজ্জার ব্যাপার। সরকার এ ব্যাপারে গাঁ বাঁচানোর চেষ্টা করছে। সরকারকে বললে বলে আমরা তো মামলা করিনি, জনগণ করেছে। কিন্তু সরকার পক্ষের আইনজীবীরা তো কোর্টে দাঁড়িয়ে বলেন না, এটা ঠিক হয়নি। নিরপরাধ যাঁরা ১০ মাস ধরে জেলে আটক আছেন, তাঁদের ব্যক্তি স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার দায় কিন্তু তাদেরই।’
আটক ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে বিচার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সারা হোসেন। তিনি বলেন, ‘জামিনের আদেশ নিয়ে যে কথা হচ্ছে, তাতে বলা হচ্ছে জুলাই-আগস্টের কোনো মামলাতেই কোনো জামিন হবে না। এই যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় সরাসরি রাষ্ট্রের কোনো বাহিনী বা কর্তৃপক্ষের না হলেও এ ক্ষেত্রে তাদের অনুপস্থিতি এবং গাফিলতি রয়েছে। ক্ষমতাধররা মনে করেন আপনার যে-ই অধিকার আছে, তা আপনার প্রতিপক্ষের নেই। এমন ভাবনার জায়গা থেকে সরে আসতে হবে।’
বিচারব্যবস্থা ঠিক করার প্রশ্নে সারা হোসেন বলেন, অন্তত এখানে একটি জায়গা তৈরি করতে হবে, যেন মানুষ বিচার চাইতে পারে।
বিচারব্যবস্থায় শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড রাখার প্রতিবাদ জানান সারা হোসেন। তিনি বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের এই আমূল পরিবর্তনের পর আমরা কেন নতুন করে ভাবতে পারিনি? বর্তমান সরকারে বেশ কয়েকজন আছেন, যাঁরা সারা জীবন মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। সরকারে গিয়ে কেন তাঁরা বললেন, তাঁরা জনগণকে বোঝাতে পারবেন না? তাঁরা তো চেষ্টাই করেননি।’
সংখ্যালঘুদের ওপর অন্যায় হলে তারা ভয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না বলে মন্তব্য করেন সারা হোসেন। ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করার সংস্কৃতি পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন বলেন তিনি। সারা হোসেন বলেন, ‘আমরা কি এটাই চেয়েছিলাম? নাকি চেয়েছিলাম যে সত্য উদ্ঘাটন হবে, জবাবদিহির ব্যবস্থা হবে, বিচার হবে, ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা হবে। সেখান থেকে আমরা অনেক দূরে আছি। সেখানে কেমন করে যাওয়া যাবে, সেটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।’
গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়েছেন, লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ, অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান, লেখক ও গবেষক মাহা মীর্জা, তরুণ গবেষক সহুল আহমদ প্রমুখ ৷
সূত্র: প্রথম আলো
