শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫
Natun Kagoj
শিরোনাম
  • বিমানবন্দরের ‘ফ্লাইং জোনে’ মাইলস্টোন, সরানোর সুপারিশ পরিকল্পনাবিদদের নতুন সংবিধানের জন্য আমরা রাজপথে নেমেছি : নাহিদ ইসলাম দক্ষিণাঞ্চলের সব নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে, লোকালয়ে জলাবদ্ধতা বাংলাদেশ বিনির্মাণে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে চাইঃ এ্যানি বঙ্গোপসাগর দিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপে নারী-শিশুসহ ২০ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ মোহাম্মদপুরে ছিনতাই: দায়িত্বে গাফিলতির অভিযোগে ৪ পুলিশ ক্লোজড মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত বেড়ে ৩৩, হাসপাতালে ৫০ জন মূল সংস্কার ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হিমশিম খাচ্ছে কমিশন ‘ওসি হয়েও আমার কমদামি ফোন, আপনি দামি ফোন নিয়ে ঘুরলে ছিনতাই হবেই’ মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি: ‘আমি ভালো আছি’ বলেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলো মাহতাব
  • অনুসন্ধান-১, ৯৪০ কোটি টাকার ‘অবৈধ সাম্রাজ্য’

    সাউথ বাংলা ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমানের সম্পদ ও প্রভাবের নেপথ্য কাহিনি

    সাউথ বাংলা ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমানের সম্পদ ও প্রভাবের নেপথ্য কাহিনি
    গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

    বাংলাদেশের আর্থিক খাত যখন নানামুখী দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে প্রশ্নের মুখে, তখন সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের (এসবিএসি) চেয়ারম্যান মো. মোখলেছুর রহমানের বিরুদ্ধে ৯০০ কোটির বেশি অবৈধ সম্পদের অভিযোগ নতুন করে জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। একটি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকের শীর্ষ পদে বসে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার এই অভিযোগ শুধু ব্যক্তি নয়, বরং পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর বড় ধাক্কা।


    চলতি বছর ১০ ফেব্রুয়ারি মো. আব্দুল হান্নান নামে এক ব্যক্তি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) মোখলেছুর রহমানের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগে বলা হয়, তিনি সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতা কাজী নাবিল আহমেদের অবৈধ অর্থের মূল রক্ষণাবেক্ষণকারী ছিলেন।

    ১৯৯৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মোখলেছুর রহমান জেমকন গ্রুপে চাকরি করার সুবাদে নাবিল আহমেদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। পরে বেনামি বিনিয়োগের মাধ্যমে গড়ে তোলেন বিএন্ডটি গ্রুপ। অভিযোগ অনুসারে, জেমকন গ্রুপের অর্থ এবং কাজী নাবিলের অবৈধ অর্থের এক বিশাল অংশ তিনি নিজের, স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ের নামে বিনিয়োগ করেন এবং বিপুল সম্পত্তির মালিক বনে যান।

    প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ছয়টি ব্যাংকে মোখলেছুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে রয়েছে প্রায় ৯৪০ কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোজিট। এর মধ্যে সাউথ বাংলা ব্যাংকে রয়েছে ৩০০ কোটি, এনসিসি ব্যাংকে ২২০ কোটি, সাউথইস্ট ব্যাংকে ২১৬ কোটি, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে ১৮৫ কোটি, ইউসিবি ব্যাংকে ৫৪ কোটি এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে ৬৪ কোটি টাকা।

    তথ্য অনুযায়ী, এসব অর্থের কোনো বৈধ উৎস আয়কর নথিতে প্রদর্শন করা হয়নি, বরং তা সম্পূর্ণভাবে গোপন রাখা হয়েছে।

    অভিযোগে বলা হয়, মোখলেছুর রহমানের নামে তেজগাঁওয়ের শান্তা ওয়েস্টার্ন টাওয়ারে ছয়টি ফ্লোর রয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ২৮০ কোটি টাকা। বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ে তার ১৫ তলা ভবনের মূল্য ৪০০ কোটি টাকা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নিজের নামে ১০ বিঘা জমি (৩০০ কোটি), পরিবারের অন্যদের নামে আরও ৬ বিঘা (১৭০ কোটি), গুলশানে ছেলের নামে একটি বাড়ি (১০০ কোটি) এবং বনানীতে স্ত্রী-সন্তানের নামে আরও বাড়ি রয়েছে যার মোট বাজারমূল্য আনুমানিক ১৫০ কোটি টাকা।

    এছাড়া চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদাহ, পঞ্চগড়সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ৩০৩ বিঘারও বেশি জমি রয়েছে মোখলেছুর রহমান ও তার পরিবারের নামে। সব মিলিয়ে যার মূল্য প্রায় হাজার কোটি টাকার বেশি।


    জুলাই ২০২৪ পরবর্তী রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে মোখলেছুর রহমান নিজেকে সুকৌশলে এসবিএসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে বসান। এরপর থেকেই ব্যাংকের নিয়ম ভেঙে নিজের লোকদের নিয়োগ দেওয়া শুরু করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, এনআরবিসি ব্যাংকের অতিরিক্ত এমডি রবিউলকে এমডি করার চেষ্টা, যিনি নিজেই দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত।

    তিনি আরও নিয়োগ দেন ডিএমডি পদে নাজিমুদ্দৌলাকে, যার নিয়োগ প্রক্রিয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো গাইডলাইন অনুসরণ না করে, ব্যক্তিগত ক্ষমতার জোরে করা হয়।

    এছাড়া অভিযোগ রয়েছে যে, আত্মীয়-স্বজনদেরও অত্র ব্যাংকে অবৈধভাবে চাকরি দিয়েছেন তিনি। এতেই ধারণা করা হচ্ছে, এসব নিয়োগের মাধ্যমে তিনি ব্যাংকের অর্থ লোপাটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

    মোখলেছুর রহমান বিএন্ডটি গ্রুপের অধীনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন বিএন্ডটি কোল্ড স্টোরেজ, বিএন্ডটি ট্রান্সফরমারস, বিএন্ডটি মিটার ইত্যাদির মাধ্যমে খাদ্য অধিদপ্তর এবং বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের টেন্ডারে অংশগ্রহণ করেন। অভিযোগ রয়েছে, এসব টেন্ডারে সিন্ডিকেট বানিয়ে অবৈধভাবে লাভবান হন তিনি।

    বিশেষ করে আলুর বাজারে তিনি কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অতিরিক্ত দাম বাড়ান, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর এবং সরকারও হয় সমালোচনার শিকার।

    কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও দুদক, এনবিআর কিংবা বিএফআইইউ, কোনো প্রতিষ্ঠানই দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি তদন্ত শুরু হয়েছে কিনা, তাও জানা যায়নি।

    একজন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে এত বড় মাপের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তার বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন ব্যাংক খাতে ‘রাজনৈতিক প্রভাব’ ও ‘দায়মুক্তির সংস্কৃতির’ নগ্ন উদাহরণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে।

    কেবল ব্যক্তি মোখলেছুর রহমান নন, ব্যবস্থা ও নীতির দুর্বলতাই এমন অবৈধ সম্পদ জালের জন্ম দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, এই অভিযোগগুলো কি যথাযথ তদন্ত হবে, না কি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ধামাচাপা পড়ে যাবে?

    এক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকিং বিশ্লেষক বলেন, ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে বসে কেউ যদি ৯০০ কোটির বেশি অবৈধ সম্পদের মালিক হন, এটি শুধু ব্যক্তিগত দুর্নীতি নয়, বরং গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থার শৃঙ্খলা ও নিরপেক্ষতা ভেঙে দেওয়ার নামান্তর। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিরও চরম ব্যর্থতা। তদারকি জোরদার না হলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ধসে পড়বে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করা নয়, তাদের বিচারের আওতায় আনা। না হলে জনগণের অর্থ ও আস্থা দুটোই হারাবে ব্যাংক খাত, যার চরম মূল্য দিতে হবে পুরো জাতিকে।

    বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এক ডেপুটি গভর্নর বলেন, অভিযোগের ধরন এবং সম্পদের পরিমাণ এতই ভয়াবহ যে, তা নিয়ে অবিলম্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা দেখছি, এখনও কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই। এর ফলে সরকারের ভাবমূর্তি যেমন ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, তেমনি ব্যাংক খাতের উপর জনআস্থা দ্রুত কমছে।

    ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞ ও প্রাক্তন আর্থিক এক উপদেষ্টা বলেন, একজন চেয়ারম্যান যদি এমন বিপুল সম্পদের মালিক হন এবং তা আয়ের উৎস হিসেবে ব্যাখ্যা করতে না পারেন, তবে তা স্পষ্টতই মানি লন্ডারিংয়ের পর্যায়ে পড়ে। বিএফআইইউ’র উচিত ছিল সঙ্গে সঙ্গে সন্দেহভাজন লেনদেন চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া। তার স্থায়ী সম্পত্তিগুলো নিয়েও তদন্ত জরুরি।

    ব্যাংক আইন বিশেষজ্ঞ রুবাইয়াৎ ফেরদৌস বলেন, কোনো ব্যক্তি যদি শেয়ার কিনে ব্যাংকের মালিকানা ও চেয়ারম্যান পদে বসেন, সেটি আইনসিদ্ধ হতে পারে। কিন্তু যখন সেই বিনিয়োগের উৎসই অবৈধ, তখন ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী তা বাতিলযোগ্য। বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে অনিয়ম প্রমাণিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে পদচ্যুত করতে পারে।

    একজন সিনিয়র ব্যাংকিং রিপোর্টার ও বিশ্লেষক বলেন, এই ঘটনা প্রমাণ করে, ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামোতে অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে, যেগুলো ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে পুরো ব্যাংক খাতে।


    বিশেষজ্ঞদের দাবি, বাংলাদেশ ব্যাংকের তাত্ক্ষণিক পদক্ষেপ ও অভিযোগ যাচাই করে চেয়ারম্যানকে সাময়িকভাবে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া। দুদক, বিএফআইইউ এবং এনবিআরের সমন্বয়ে একটি যৌথ তদন্ত দল গঠন করে বিস্তারিত সম্পদ যাচাই। চেয়ারম্যান ও পরিবারের সদস্যদের ট্যাক্স ফাইল, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং বিদেশে সম্পদের তথ্য যাচাই। চেয়ারম্যান বা পরিচালকদের পক্ষপাতদুষ্ট নিয়োগ বন্ধ এবং নিয়োগ পদ্ধতিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে আনা।

    ব্যাংক খাত শুধু ব্যবসা নয়, এটি জনগণের সঞ্চিত অর্থের রক্ষাকবচ। এই খাতে দুর্নীতির শেকড় উপড়ে না ফেললে, আর্থিক অব্যবস্থাপনা আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিকে চরম ঝুঁকিতে ফেলবে এমনটাই সতর্ক করে দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।


    গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

    সর্বশেষ

    আরও পড়ুন  

    A PHP Error was encountered

    Severity: Core Warning

    Message: PHP Startup: Unable to load dynamic library 'tidy.so' (tried: /opt/cpanel/ea-php74/root/usr/lib64/php/modules/tidy.so (libtidy.so.5: cannot open shared object file: No such file or directory), /opt/cpanel/ea-php74/root/usr/lib64/php/modules/tidy.so.so (/opt/cpanel/ea-php74/root/usr/lib64/php/modules/tidy.so.so: cannot open shared object file: No such file or directory))

    Filename: Unknown

    Line Number: 0

    Backtrace: