গাজার জন্য ১০ ঘণ্টার নীরবতা; মানবতা না কৌশলগত ছলনা?


গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর প্রতিদিন ১০ ঘণ্টার জন্য সামরিক অভিযান স্থগিত রাখার ঘোষণাকে কেউ কেউ স্বস্তির নিঃশ্বাস হিসেবে দেখছেন। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, এই তথাকথিত ‘কৌশলগত বিরতি’ আসলে মানবিক নয়, বরং কূটনৈতিক চাপ ও সমালোচনা সামাল দেওয়ার একটি রাজনৈতিক কৌশল।
স্থানীয় সময় সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত তিনটি এলাকায় মুওয়াসি, দেইর আল-বালাহ এবং গাজার কিছু অংশে সামরিক তৎপরতা বন্ধ রাখার ঘোষণা এসেছে এমন সময়ে, যখন গাজার মানবিক পরিস্থিতি ভয়াবহ সংকটে। খাদ্য, ওষুধ, পানি সব কিছুরই তীব্র ঘাটতি; বিদ্যুৎ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। সর্বশেষ শনিবার ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্সের দেওয়া তথ্যে দেখা গেছে, গাজায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের অনেকে ত্রাণের জন্য লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় প্রাণ হারিয়েছেন। শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে হিমশিম খাচ্ছে।
এমন প্রেক্ষাপটে ‘কৌশলগত বিরতি’ শব্দ দুটি যে অসহায় মানুষের সঙ্গে নির্মম পরিহাস, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। কারণ, এই বিরতির মধ্যেও আকাশে ড্রোন, টহল ও নজরদারি চালু থাকছে, যার অর্থ ‘নিরাপদ করিডোর’ বললেও সেখানকার সাধারণ মানুষ কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে গভীর সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
ইসরায়েলি বাহিনী বলছে, তারা এই বিরতির মাধ্যমে খাদ্য, ওষুধ ও জরুরি সহায়তা সরবরাহে সহায়তা করতে চায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে সেনাবাহিনী একই দিনে গাজা উপকূলে ত্রাণবাহী ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা’ জব্দ করে, যে বাহিনীর আক্রমণে ত্রাণ নিতে আসা সাধারণ মানুষ নিহত হয়, তাদের মুখে এই ধরনের মানবিক বিবৃতি বিশ্বাসযোগ্যতা পায় কীভাবে?
দীর্ঘদিন ধরে চলমান অবরোধ, প্রতিনিয়ত বোমাবর্ষণ ও নাগরিক অবকাঠামোর ধ্বংসের মধ্য দিয়ে গাজা আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধবিরতির আলোচনা ভেঙে পড়ার পর ইসরায়েল গাজায় ‘পূর্ণ অবরোধ’ আরোপ করে। এরপর মাঝে মাঝে সামান্য কিছু ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দিলেও তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। এর মধ্যেই ১০ ঘণ্টার এই সাময়িক বিরতি যেন ধূসর ধ্বংসস্তূপে একটি ‘সাদা কাগজের প্রতিশ্রুতি’ ছাড়া কিছু নয়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এ বিষয়ে করণীয় অনেক। এখনই তাদের স্পষ্ট বার্তা দেওয়া প্রয়োজন ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য সাময়িক বিরতির চেয়ে জরুরি হলো পূর্ণ যুদ্ধবিরতি ও স্থায়ী শান্তিপূর্ণ সমাধান। সহিংসতা বন্ধ না হলে এই ‘বিরতি’র মধ্যেও মৃত্যু অব্যাহত থাকবে, খাদ্য বিতরণের লাইনে দাঁড়িয়েও মানুষ মরবে।
এই সময়েই প্রমাণ করার পালা মানবাধিকার আদতে একটি বাস্তব নীতিনির্দেশনা, না কি শুধুই আন্তর্জাতিক বক্তৃতার অলংকার। গাজার জন্য এখন কৌশল নয়, প্রয়োজন আন্তরিক মানবতা, নিরঙ্কুশ যুদ্ধবিরতি এবং টেকসই রাজনৈতিক সমাধান।
