বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
Natun Kagoj
গণমাধ্যমে অযোগ্যদের দাপট:

সাংবাদিকতার সংকট ও উত্তরণের পথ

সাংবাদিকতার সংকট ও উত্তরণের পথ
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এক সময় সত্যের পক্ষে নির্ভীক কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত ছিল। গণমানুষের দুর্দশা তুলে ধরা, রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা, এবং শাসকদের জবাবদিহিতার মুখে দাঁড় করানোই ছিল সাংবাদিকতার মূল চেতনা। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে সাংবাদিকতার এই নৈতিক অবস্থান নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। এখন অনেক সংবাদমাধ্যমে অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা ও দক্ষতার চেয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

বিশেষ করে, এমন এক শ্রেণির উত্থান হয়েছে, যারা সত্য তুলে ধরার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের খুশি রাখতে বেশি আগ্রহী। তারা কেবল সুবিধা পাওয়ার আশায় সাংবাদিকতা করে, অথচ বাস্তবে পেশাটির মৌলিক নীতিগুলো তাদের কাছে গুরুত্বহীন। ফলে প্রকৃত সাংবাদিকরা, যারা দক্ষ ও অভিজ্ঞ, তারা ক্রমশ প্রান্তিক হয়ে পড়ছেন।

এই পরিস্থিতি সাংবাদিকতা ও সমাজ—উভয়ের জন্যই বড় সংকট তৈরি করেছে। কীভাবে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো, এর ফলে গণমাধ্যম ও সমাজ কী ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, এবং কীভাবে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব—এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক।

সাংবাদিকতার পরিবর্তন: দক্ষদের সংকোচন, সুবিধাবাদীদের প্রসার

গণমাধ্যমের আজকের অবস্থার পেছনে একাধিক কারণ কাজ করছে। সাংবাদিকতার মতো গুরুত্বপূর্ণ পেশায় যখন সঠিক নিয়ম ও নীতির চেয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ, রাজনৈতিক আনুগত্য এবং কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ প্রাধান্য পেতে থাকে, তখনই সেখানে অযোগ্যদের দাপট শুরু হয়।

১. রাজনৈতিক আনুগত্য ও সাংবাদিকতার অধঃপতন
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের বড় একটি অংশ এখন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত। অনেক সংবাদমাধ্যম সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের স্বার্থরক্ষার জন্য কাজ করছে। ফলে সেসব প্রতিষ্ঠানে সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জায়গা কমে যাচ্ছে, বরং রাজনৈতিক আনুগত্যই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

একসময় সাংবাদিকদের কাজ ছিল ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে লড়াই করা, কিন্তু এখন অনেকেই নিজেকে রাজনীতির অংশ করে ফেলেছেন। এর ফলে- প্রকৃত সাংবাদিকরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন।

সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা কমছে। জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

২. কর্পোরেট ও ব্যবসায়িক স্বার্থের প্রভাব
বর্তমানে গণমাধ্যমের বড় একটি অংশ ব্যবসায়িক স্বার্থের ওপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞাপন, স্পন্সরশিপ এবং কর্পোরেট লবির কারণে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা কমে গেছে। যেসব প্রতিবেদন ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর স্বার্থের বিপরীতে যায়, সেগুলো প্রকাশের সুযোগই পায় না।

ফলে গণমাধ্যমের অনেকেই এখন কর্পোরেট সংস্থাগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় চলেন। তাদের কাজ সত্য তুলে ধরা নয়, বরং এমন সংবাদ পরিবেশন করা যা কর্পোরেট বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের স্বার্থ রক্ষা করে। এই পরিস্থিতিতে অভিজ্ঞ ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকদের জায়গা সংকুচিত হচ্ছে, কারণ তারা এসব চাপের বাইরে থেকে কাজ করতে চান।

৩. অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সংকট
এক সময় বাংলাদেশের সাংবাদিকতা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য বিখ্যাত ছিল। কিন্তু এখন সেই ধারা প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে গেলে হুমকির মুখে পড়তে হয়, মামলা-মোকদ্দমার শিকার হতে হয়, এমনকি চাকরিও হারানোর ঝুঁকি থাকে।

ফলে সাংবাদিকদের একটি অংশ নিরাপদ পথ বেছে নিয়েছে—কঠিন বিষয়গুলো এড়িয়ে গিয়ে সুবিধামতো কাজ করা। তারা প্রশ্ন করার চেয়ে প্রচারমূলক সংবাদ তৈরিতে বেশি আগ্রহী। আর এর ফলে—
* দুর্নীতিবাজরা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
* প্রশাসনিক ব্যর্থতা জনসাধারণের নজর এড়িয়ে যাচ্ছে।
*প্রকৃত সাংবাদিকতা হারিয়ে যাচ্ছে।

সাংবাদিকতার এই সংকট সমাজে কী প্রভাব ফেলছে?
সাংবাদিকতার এই অধঃপতন শুধু গণমাধ্যমের ক্ষতি করছে না, পুরো সমাজেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

১. গণমাধ্যমের প্রতি আস্থার সংকট
যখন সংবাদমাধ্যম নিরপেক্ষতার বদলে পক্ষপাতমূলক সংবাদ প্রচার করে, তখন জনগণের মধ্যে তাদের প্রতি আস্থা কমে যায়। ফলে মানুষ বিকল্প মাধ্যমের দিকে ঝুঁকছে, যার মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই ভুল তথ্য বা গুজব ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।

২. প্রকৃত সাংবাদিকদের পেশাগত সংকট
যারা সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করতে চান, তারা এখন বেকার হয়ে পড়ছেন বা চাকরির নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। কারণ মিডিয়া হাউসগুলো তাদের জায়গায় সুবিধাবাদীদের প্রাধান্য দিচ্ছে। ফলে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই এখন আর সাংবাদিকতা পেশাকে ভবিষ্যতের জন্য নিরাপদ ভাবছেন না।

৩. জনগণের প্রকৃত সমস্যাগুলো আড়ালে চলে যাচ্ছে
গণমাধ্যমের দায়িত্ব হলো জনগণের প্রকৃত সমস্যাগুলো তুলে ধরা। কিন্তু যখন সাংবাদিকতা সত্যের পরিবর্তে সুবিধার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, তখন জনগণের দুঃখ-দুর্দশা গুরুত্ব পায় না। ফলে নীতিনির্ধারকদের কাছেও সঠিক তথ্য পৌঁছায় না, যা সমস্যার আরও বিকৃত উপস্থাপনা তৈরি করে।

উত্তরণের উপায়: কীভাবে প্রকৃত সাংবাদিকতা রক্ষা করা সম্ভব?
এই সংকট থেকে মুক্তির জন্য কিছু কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

১. নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার গুরুত্ব দেওয়া
সাংবাদিকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুগত্য বা ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়, বরং অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

২. সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ দেওয়া
গণমাধ্যমের মালিকদের উচিত সাংবাদিকদের ওপর রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক চাপ প্রয়োগ না করা। পাশাপাশি, সাংবাদিকদের জন্য পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা ভয় বা সংকোচ ছাড়াই কাজ করতে পারেন।

৩. অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে পুনরুজ্জীবিত করা
সাংবাদিকদের উৎসাহিত করতে হবে, যাতে তারা সাহসী প্রতিবেদন তৈরি করতে পারেন। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য আলাদা তহবিল গঠন করা যেতে পারে, যা নিরপেক্ষভাবে ব্যবহৃত হবে।

৪. বিকল্প ও স্বাধীন গণমাধ্যম তৈরি করা
মূলধারার গণমাধ্যম যখন চাপের মুখে, তখন স্বাধীন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, ইউটিউব চ্যানেল, এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকৃত সাংবাদিকতার চর্চা বাড়াতে হবে।

৫. জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি
পাঠক ও দর্শকদেরও সচেতন হতে হবে, যাতে তারা পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেন এবং নিরপেক্ষ সাংবাদিকতাকে সমর্থন করতে পারেন।

সাংবাদিকতার সংকট আমাদের সামগ্রিক গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। যদি সংবাদমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারে, তাহলে জনসাধারণ সঠিক তথ্য পাবে না, নীতিনির্ধারকরা ভুল সিদ্ধান্ত নেবেন, এবং দেশ সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে পড়বে।

সাংবাদিকতা কেবল একটি পেশা নয়, এটি জনগণের জন্য সত্য বলার এক অনন্য মাধ্যম। সেই সত্য যদি স্বার্থান্বেষী মহলের কাছে বন্দি হয়ে যায়, তাহলে গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাই বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাই এখনই সময় প্রকৃত সাংবাদিকতাকে রক্ষা করার, অযোগ্য ও সুবিধাবাদীদের জায়গা সংকুচিত করার এবং সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কলম ধরার।

লেখক: আহমেদ শাহেদ
কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও পেশাদার বাচিক শিল্পী।


নতুন/কাগজ/শাহেদ/মুক্তমত
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

সর্বশেষ