বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
Natun Kagoj

গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা ও সুষ্ঠু নির্বাচন: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা ও সুষ্ঠু নির্বাচন: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হল জনগণের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার। নির্বাচন একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, যা দেশের নেতৃত্ব নির্বাচন করতে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। এটি জনগণের মতামত প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম, যেখানে ভোটের মাধ্যমে জনগণ তাদের পছন্দের নেতাদের নির্বাচিত করতে পারে।

নির্বাচন না হলে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হওয়া সম্ভব নয়, ফলে গণতন্ত্রের ধারণা খাটো হয়ে যায়। মুক্ত, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন দেশের উন্নয়ন এবং শাসনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মাধ্যমে জনগণ তাদের ভবিষ্যতের জন্য সঠিক নেতৃত্ব নির্বাচন করতে পারে, যা দেশের নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।

তবে, নির্বাচন প্রক্রিয়া যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই গুরুত্বপূর্ণ তা সুষ্ঠু, স্বাধীন এবং স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হওয়া। নির্বাচন যদি প্রভাবিত হয় বা অসচ্ছতার মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়, তবে গণতন্ত্রের জন্য এর প্রভাব বিপর্যস্ত হতে পারে। সুতরাং, গণতন্ত্রের জন্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অপরিহার্য।


গণতন্ত্র বলতে বোঝানো হয় এমন একটি শাসনব্যবস্থা, যেখানে জনগণ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচন করে, এবং এই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশের আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন এবং সরকারের পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গণতন্ত্রের সবচেয়ে মৌলিক উপাদান হচ্ছে জনগণের সঠিক মতামত এবং তাদের অংশগ্রহণের অধিকার। এই অংশগ্রহণের প্রধান মাধ্যম হল নির্বাচন।

নির্বাচনের গুরুত্ব:

১. জনগণের ক্ষমতা প্রকাশের মাধ্যম: নির্বাচন হলো গণতন্ত্রের হৃদয়। এটি জনগণের ক্ষমতাকে প্রতিনিধিত্ব করে। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের পছন্দের সরকার ও প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করতে পারেন, যারা তাদের স্বার্থের দিকে মনোযোগ দিয়ে দেশ পরিচালনা করবেন। যদি নির্বাচন না হয়, তবে জনগণের অধিকার সীমিত হয়ে যায় এবং এটি একটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় পরিণত হতে পারে।

২. প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন: গণতন্ত্রে জনগণ তাদের মতামত জানাতে এবং নীতি-নির্ধারণে অংশ নিতে পারেন, তবে এটি তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে হয়। যদি নির্বাচন না হয় বা সঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, তবে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হওয়া সম্ভব হয় না। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের সমস্যা ও চাহিদা সম্পর্কে জানেন এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের এই প্রতিনিধিত্বের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

৩. সরকারের জবাবদিহিতা: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, নির্বাচিত সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহি থাকে। নির্বাচন হচ্ছে সেই সুযোগ, যার মাধ্যমে জনগণ সরকারের কর্মসূচি, নীতি এবং কার্যক্রমের মূল্যায়ন করতে পারে। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে এবং তারা জানায়, কে তাদের শাসন করতে পারে।

৪. স্বাধীনতা ও স্বাধীন চিন্তা: নির্বাচন হচ্ছে স্বাধীনতা এবং ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তার পরিচায়ক। গণতন্ত্রের প্রক্রিয়ায়, জনগণ তাদের মতামত স্বাধীনভাবে জানাতে পারে। নির্বাচন সাধারণত দলীয় বা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ভিত্তিতে হয়ে থাকে, যেখানে জনগণ তাদের পছন্দ অনুযায়ী ভোট দিতে পারেন। এটি রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের একমাত্র সুযোগ, যা একটি দেশের জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করে।

৫. স্বচ্ছতা ও দায়িত্ববোধ: সুষ্ঠু নির্বাচন জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা এবং সরকার ও প্রতিনিধির প্রতি দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি করে। নির্বাচনের সময় সরকারের কার্যক্রম এবং তাদের নীতি নিয়ে আলোচনা এবং বিতর্ক হয়, যা জনগণকে আরও সচেতন এবং প্রভাবিত করে। এর ফলে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আরও স্বচ্ছভাবে তাদের কাজ করতে বাধ্য হয়, কারণ তাদের জানানো হয় যে, পরবর্তী নির্বাচনে জনগণ তাদের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করবে।

নির্বাচন না হলে গণতন্ত্রের জন্য বিপদ:

যদি নির্বাচনের প্রক্রিয়া না থাকে বা নির্বাচন সুষ্ঠু না হয়, তাহলে গণতন্ত্রের পরিপূর্ণ কার্যকারিতা ব্যাহত হতে পারে। এর ফলে:

১. স্বৈরতন্ত্রের উত্থান: নির্বাচন না হলে ক্ষমতা এক ব্যক্তির বা একটি দলের হাতে কেন্দ্রীভূত হতে পারে, এবং এতে গণতন্ত্রের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা সংকুচিত হয়। একগুয়ে শাসনব্যবস্থা বা স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, যা জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে এক পক্ষের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়।

২. আত্মবিশ্বাসের অভাব: যদি নির্বাচনে জনগণের মতামত গুরুত্ব না পায় বা নির্বাচনী প্রক্রিয়া অস্পষ্ট বা ত্রুটিপূর্ণ হয়, তাহলে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে হতাশা এবং অনাস্থা সৃষ্টি হয়। এর ফলে জনগণের সমাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ কমে যেতে পারে, যা সরকারের কার্যকারিতাকে দুর্বল করে দেয়।

৩. দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা: নির্বাচন না হলে বা অসচ্ছভাবে নির্বাচিত হলে, সরকারের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। যেহেতু জনগণের দ্বারা তাদের নেতা বা প্রতিনিধিরা নির্বাচন করা হয় না, তারা নিজেদের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যার ফলে জনগণের প্রতি সরকারের দায়িত্ব কমে যায়।

গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন একটি অপরিহার্য প্রক্রিয়া। এটি শুধু সরকারের দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করে না, বরং জনগণের মতামতের প্রতিফলন এবং তাদের স্বাধীনতা রক্ষা করে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সুষ্ঠু, স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলে, গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য ও কার্যকারিতা ব্যাহত হতে পারে, এবং তা জাতির ভবিষ্যতের জন্য বিপদজনক হতে পারে। সুতরাং, গণতন্ত্রের মজবুত ভিত্তি রাখতে নির্বাচন একটি অপরিহার্য উপাদান।


নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ববোধ

নির্বাচন একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মৌলিক অংশ এবং এটি পরিচালনা করার জন্য একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য প্রশাসনিক কাঠামোর প্রয়োজন। এমন পরিস্থিতিতে, যখন একটি নতুন নির্বাচনী প্রক্রিয়া বা নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়, তখন এই সরকারের কাছে বিশেষ কিছু দায়িত্ব ও দায়িত্ববোধ থাকে, যা গণতন্ত্রের সঠিক কার্যকারিতাকে নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাধারণত দেশের নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিচালনা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন শাসন পরিচালনা করে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ববোধের কয়েকটি মূল দিক নিম্নরূপ:

১. নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করা:
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব হল সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্য পরিবেশ তৈরি করা। সরকারের উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা এবং নির্বাচন কমিশনকে পূর্ণ স্বাধীনতা ও সহায়তা প্রদান করা যাতে নির্বাচন স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়। তারা নির্বাচনকালে কোন পক্ষের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা বা অন্যায়ভাবে শাসন ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে না।

২. নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা:
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে বাধ্য। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচন আইন মেনে চলা, ভোট গ্রহণ কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভোটারদের সঠিক তথ্য প্রদান করা এবং নির্বাচনী বিধিমালা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা। নির্বাচনের ফলাফল কোনো ধরনের প্রভাব বা অস্বচ্ছতা মুক্ত থাকতে হবে।

৩. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা:
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা। নির্বাচনকালীন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা বা সহিংসতা এড়াতে এই সরকারের উচিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা এবং সাধারণ জনগণের শান্তি বজায় রাখা। যে কোনও ধরনের বিশৃঙ্খলা বা অস্থিরতার সৃষ্টি হলে তা নির্বাচনের সুষ্ঠুতা ও গণতন্ত্রের মৌলিক উদ্দেশ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

৪. মতামতের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা:
গণতান্ত্রিক দেশে, নির্বাচনের প্রক্রিয়া চলাকালে জনগণের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব হল রাজনৈতিক দলের প্রচার-প্রচারণা, নির্বাচনী আচরণবিধি এবং ভোটারদের অধিকার সুরক্ষা করা। কোনো রাজনৈতিক দল বা নির্বাচনী প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবিচার বা হুমকি দেয়া চলবে না। নির্বাচনকালীন সময়ে জনগণের ভোটের স্বাধীনতা ও তাদের মতামত প্রকাশের অধিকার যেন অব্যাহত থাকে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

৫. মুক্ত সংবাদমাধ্যম এবং প্রতিবাদী মতামতের সুরক্ষা:
গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ হল মুক্ত সংবাদমাধ্যম এবং জনগণের প্রতিবাদ করার অধিকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে এবং গণমাধ্যমের কাজের স্বাধীনতা যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি, প্রতিবাদী মতামত এবং আন্দোলনগুলোকেও শান্তিপূর্ণ ও আইনসঙ্গত উপায়ে পরিচালিত হতে দিতে হবে।

৬. ঐক্য এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখা:
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল সকল রাজনৈতিক দল এবং জনগণের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখা। জনগণের মধ্যে নির্বাচনের সুষ্ঠুতা ও স্বচ্ছতা সম্পর্কে বিশ্বাস তৈরি করার জন্য সরকারের উচিত জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, যাতে জনগণ মনে করে যে নির্বাচন সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং তাদের ভোটের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে।

তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব শুধুমাত্র নির্বাচনের প্রস্তুতি বা পরিচালনা করা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক মূলনীতি বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি এই সরকার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে তার দায়িত্ব পালন করে, তাহলে তা গণতন্ত্রের শুদ্ধতা এবং জনগণের আস্থার প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।


লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক নতুন কাগজ


গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

সর্বশেষ