ব্যাংক হিসাব স্থগিত, বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ, কর ফাঁকি ও অর্থপাচার! কে এই শরীফ জহির?


বাংলাদেশের কর ও আর্থিক খাতের একাধিক আলোচিত কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে আছেন ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের (ইউসিবি) চেয়ারম্যান ও অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শরীফ জহির।
সর্বশেষ, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) তার এবং পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে। একইসঙ্গে তার বিরুদ্ধে রয়েছে রাজস্ব ফাঁকি, অর্থপাচার, ভূমি দখল এবং শ্রমিক নির্যাতনের গুরুতর অভিযোগ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) আবেদনের ভিত্তিতে বিএফআইইউ এই সিদ্ধান্ত নেয়। শরীফ জহির ছাড়াও তার মা কামরুন নাহার, ভাই আসিফ জহির এবং সহযোগী সৈয়দ ইশতিয়াক আলমের ব্যাংক হিসাবও স্থগিত করা হয়েছে।
আবেদনে বলা হয়, আয়কর আইন ২০২৩ এর ২২৩ ধারা অনুযায়ী, রাজস্ব স্বার্থ রক্ষার্থে সংশ্লিষ্টদের নামে থাকা সকল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, কার্ড এবং লকার থেকে অর্থ উত্তোলন ও স্থানান্তর বন্ধ করতে হবে।
অনন্ত ডেনিমে শত কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি
২০১৯ সালের একটি তদন্তে দেখা যায়, শরীফ জহিরের মালিকানাধীন অনন্ত ডেনিম টেকনোলজি লিমিটেড সরকার প্রদত্ত বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি করেছে, যার মাধ্যমে তারা প্রায় ১০৩ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেয়।
শুল্ক গোয়েন্দা দল ২৩ লাখ কেজির বেশি ডেনিম ফেব্রিকস ও প্রায় ৩০ লাখ কেজি ডাইস কেমিক্যাল আমদানির তথ্য বিশ্লেষণ করে ফাঁকির প্রমাণ পায়। একাধিক রাজস্ব কর্মকর্তার অংশগ্রহণে সম্পন্ন এই তদন্তের প্রতিবেদন এখনো কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়নি, বরং বলা হচ্ছে, “অদৃশ্য প্রভাব” ব্যবহার করে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয়।
রোলস-রয়েস কেলেঙ্কারি: শুল্ক ফাঁকি ও জব্দ
২০২৪ সালে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল বিলাসবহুল ব্রিটিশ গাড়ি রোলস-রয়েস কালিনান আমদানি করে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা। কাস্টমস গোয়েন্দা বিভাগ জানায়, গাড়িটি শুল্কায়ন ছাড়াই ঢাকার বারিধারায় শরীফ জহিরের বাসভবনে গ্যারেজে লুকিয়ে রাখা হয়। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে তা জব্দ করা হয়। যদি গাড়িটি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে পার পেত, তবে সরকার হারাত ২৪ কোটি টাকার রাজস্ব। পরে জরিমানা ও শুল্কসহ গাড়ি ছাড়াতে ৮৫ কোটি টাকার হিসাব দাঁড়ায়, যা প্রায় ৩০ গুণ বেশি।
অর্থপাচার ও অফশোর বিনিয়োগ: পানামা পেপার্সে নাম
পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্স কেলেঙ্কারিতে নাম রয়েছে শরীফ জহিরের। এই ঘটনায় দুদক তার বিরুদ্ধে অর্থপাচার, কর ফাঁকি এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করেছে। ২০২৪ সালে বিএফআইইউ-এর সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দিয়েছে দুদক।
দুদকের কর্মকর্তারা জানান, অনন্ত গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে উপার্জিত অর্থ বিদেশে পাচার ও অফশোর কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে সন্দেহ রয়েছে।
ভূমি দখল ও শ্রমিক নির্যাতন
শুধু আর্থিক নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রেও বারবার আলোচনায় এসেছে শরীফ জহিরের নাম। আদমজী ইপিজেডের একটি কারখানায় শ্রমিক নির্যাতন, বেতন না দেওয়া ও বেআইনিভাবে ছাঁটাইয়ের অভিযোগে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ হয় ২০১৯ সালে। অভিযোগ রয়েছে, তার রিয়েল এস্টেট কোম্পানি জোরপূর্বক জমি দখল করেছে, যার প্রেক্ষিতে থানায় সাধারণ ডায়েরিও হয়েছে।
ক্ষমতার ছত্রছায়ায় ধামাচাপা?
অনুসন্ধান বলছে, পূর্ববর্তী সরকারের শীর্ষপর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকায় বারবার পার পেয়ে গেছেন শরীফ জহির। সাবেক মুখ্যসচিব আহমেদ কায়কাউস এবং আইসিটি প্রতিমন্ত্রী পলকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে প্রভাব বিস্তার করেন। অথচ বর্তমান সরকারের আমলে পরিস্থিতি পাল্টে যাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআর এর এক সদস্য জানান, এবার আর আগের মতো ধামাচাপা দেওয়া যাবে না, তদন্ত চলবে, ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শরীফ জহিরের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা শুধু দীর্ঘ নয়, প্রমাণও অপ্রতুল নয়। দেশের রাজস্ব, আইনের শাসন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের স্বার্থে এমন ব্যক্তি যেন আইনের ফাঁক গলে পালিয়ে যেতে না পারেন এ দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী, সচেতন মহল ও এলাকাবাসী। কেউ কেউ সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
শরীফ জহিরের প্রতিউত্তরের জন্য একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
