তবে কি লেবাননেও ছড়াতে যাচ্ছে গাজার যুদ্ধ!


ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের এক নেতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়ার কথা বলেছেন লেবাননের শক্তিশালী মিলিশিয়া গোষ্ঠীর নেতা। যুদ্ধ কি এবার ছড়াবে?
বৈরুতের ৫৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তির মতে, লেবাননের রাজধানীতে নিরাপত্তা বিষয়টিই আপেক্ষিক।
তিনি বলেন, ‘এই সপ্তাহে যে আক্রমণ হয়েছে, তার আগে থেকেই ইসরাইলের বিমান মাথার উপর দিয়ে গেছে। কিন্তু মঙ্গলবারের আক্রমণ অনেক জোরাল মনে হয়েছে। কারণ সেটা আবাসিক এলাকায় হয়েছে।’
এই ব্যক্তি যে ঘটনার কথা বলছেন, সেটি হলো একটি ড্রোন আক্রমণ। যার ফলে হামাসের শীর্ষস্থানীয় নেতা সালেহ আল-আরৌরি নিহত হয়েছেন। ইসরাইল এখনো সরাসরি এই আক্রমণের দায় স্বীকার করেনি। তারা শুধু বলেছে, হামাস নেতারা যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের হত্যা করা হবে।
৩০ বছর বয়সী এক শিক্ষক বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমরা নিরাপদ আছি। কিন্তু পরের মুহূর্তে যে বোমা পড়বে না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই।’
তবে এরপরেও বৈরুতের যে বাসিন্দাদের সাথে কথা বলেছে, তারা কেউই চায় না যে হিজবুল্লাহ ইসরাইলের সাথে যুদ্ধ শুরু করুক। নিরাপত্তার খাতিরে তারা সকলেই নিজের নাম গোপন রেখেছেন। তাদের বক্তব্য, তারা আঞ্চলিক যুদ্ধের পক্ষে নন।
বৈরুতে ৪৫ বছর বয়সী খুচরা ব্যবসায় সহকারীর কাজ করা এক ব্যক্তি জানান, ‘হিজবুল্লাহ ডেটারেন্ট হিসেবে কাজ করে। যার ফলে ইসরাইল লেবাননে ঢুকতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘হিজবুল্লাহই তাদের সুরক্ষা দিতে পারে।’
কিন্তু একই সাথে তিনি বলেন, ‘কেউই যুদ্ধ চায় না। আমি চাই হিজবুল্লাহ আরো সতর্ক থাকুক।’
জরুরি ভাষণ
হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহের ভাষণের দিকে সকলের নজর পড়েছে। বুধবার তিনি জানান, ইসরাইল একটা ভয়ঙ্কর ও বিপজ্জনক অপরাধ করেছে।
নাসরাল্লাহের মন্তব্যের ব্যাখ্যা করা কঠিন। হিজবুল্লাহ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন এমন পর্যবেক্ষকদের মতে, ‘আগের ভাষণের তুলনায় তার কথার ভঙ্গি ছিল খুবই আগ্রাসী।’
আবার লেবাননের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদাল্লাহ হাবিব মনে করেন, ‘হিজবুল্লাহ এখনই ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে না।’
তিনি মার্কিন চ্যানেল সিএনএনকে বলেন, ‘আমরা আশা করতে পারি, হিজবুল্লাহ নিজেদের কোনো বড় যুদ্ধে জড়াবে না। এর পেছনে প্রচুর কারণ হয়েছে। লেবাননে কেউই এখন যুদ্ধ চাইছে না।’
২০০৬ সালে ইসরাইলের সেনা ও হিজবুল্লাহ ৩৪ দিন ধরে লড়েছিল। প্রচুর ইসরাইলি সেনাকে হিজবুল্লাহ পণবন্দী করেছিল। লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। এক হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল। লেবাননের পরিকাঠামো খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহারের মধ্যে দিয়ে লড়াই শেষ হয়।
২০০৬ সালের পর থেকে হিজবুল্লাহ তাদের অস্ত্রভাণ্ডার বহুগুণে বাড়িয়েছে। তারা অত্যাধুনিক অস্ত্র জোগাড় করেছে।
মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের পররাষ্ট্র-নীতি বিশেষজ্ঞ জেফরি ফেল্টম্যান বলেন, ‘হিজবুল্লাহর কাছে এক লাখ ৫০ হাজার রকেট আছে। এর জন্যই ইসরাইল ইরানের ওপর সরাসরি আক্রমণ করতে পারে না। অথবা বলা যায়, ইরান আক্রান্ত হলে বড় ধরনের প্রত্যাঘাত করার ক্ষমতা তাদের আছে।’
হিজবুল্লাহর ‘রেড লাইন’
২০০৬ সালের পর থেকে লেবাননের উত্তর সীমান্তে মাঝেমধ্যে রকেট আক্রমণ হয়। কারণ, দু’পক্ষই ‘টিট ফর ট্যাট’ বা ‘ঢিল মারলে পাটকেল খেতে হবে’ নীতি নিয়ে চলছে।
বেশ কয়েকমাস আগে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হামাস নেতা আল-আরৌরিকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। হমাসকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয় ইউনিয়ন, জার্মানি, ইসরাইল উগ্রবাদী সংগঠন বলে ঘোষণা করেছে।
এর প্রতিক্রিয়ায় নাসরাল্লাহ বলেছিলেন, এই ধরনের হত্যাকে রেড লাইন হিসেবেই দেখা হবে। সীমান্তের ১০০ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে হামাসের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত আবাসিক এলাকায় যেভাবে আল-আরৌরিকে মারা হয়েছে, তাতে ওই রেড লাইন অতিক্রম করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমাল সাদ বলেন, ‘সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে ডেটারেন্স সংক্রান্ত ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে।’
তিনি মনে করেন, ‘সেই ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করতে হিজবুল্লাহকে দ্রুত কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা ইসরাইলকে খুব বেশি জায়গা দিতে পারবে না। কারণ, ইতোমধ্যেই ইসরাইল ঘোষণা করেছে, তারা হামাস নেতাদের যেখানে সম্ভব মারবে।’
যদিও ইসরাইল বলেছে, কাতার বা তুরস্কে গিয়েও তারা এই কাজ করতে পারে, তবে এটা হবে বলে মনে হয় না। কাতার পণবন্দীদের মুক্ত করার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। আর তুরস্কের সাথে সম্পর্ক আর খারাপ হোক, তা ইসরেইল চাইবে না। তারা খুব সম্ভবত লেবাননেই এই কাজ করতে চাইবে।
আমাল সাদ বলেন, ‘হিজবুল্লাহ খুব ভালো করে জানে যে তারা যদি প্রত্যাঘাত না করে, তাহলে ইসরাইল লেবানেন আরেকটি ফিলিস্তিনি টার্গেটে আঘাত করবে। দ্বিতীয়ত, তারা এটাও মনে করতে পারে, হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়ে গেছে।’
তার মতে, হিজবুল্লাহকে খুব সতর্ক হয়ে এমনভবে আক্রমণ করতে হবে, যার ফলে ইসরাইল যেন খুব বেশি বিব্রত না হয় এবং আরো বেশি করে প্রত্যাঘাত করে।’
লেবাননের সংবাদপত্রের সম্পাদক অ্যান্টনি সামরানি সম্পাদকীয় নিবন্ধে লেখেন, ‘৮ অক্টোবরের পর থেকে হিজবুল্লাহ এমন অবস্থায় আর পড়েনি। তারা কিছু না করলে ইসরাইল আরো বেশি করে আক্রমণ করতে পারে। আর তারা যদি খুব জোরাল প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাহলে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে।’
সূত্র : ডয়চে ভেলে
ডয়েচে ভেলে
