ইউনূস-তারেক বৈঠক ও রাজনৈতিক সংকটের নতুন মোড়


বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডন বৈঠক এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দীর্ঘদিন ধরে গৃহীত রাজনৈতিক সংঘাত ও ভিন্নমতকে একত্রিত করার প্রয়াস হিসেবে এ বৈঠককে দেখা যেতে পারে। কিন্তু এ মুহূর্তে উদয় হওয়া এই আলো কিছু প্রশ্নের ছায়াও সঙ্গে নিয়ে এসেছে।
বৈঠকের ফলাফল ও পরবর্তী যৌথ সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বিবৃতি যেমন আশা জাগাচ্ছে, তেমনই তা রাজনৈতিক বাস্তবতায় কতটা প্রতিফলিত হবে, তা নিয়েও সংশয় থেকে যায়। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হওয়া এই আলোচনা দীর্ঘ দিন ধরেই দেশে চাওয়া নির্বাচনের জন্য একটি সুগঠিত ও নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম গড়ার সংকেত দেয়। তারেক রহমানের পক্ষ থেকে রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব এবং প্রধান উপদেষ্টার এটি এপ্রিলের প্রথমার্ধে আয়োজনের ঘোষণা, একপ্রকার সমঝোতার প্রতিফলন। তবে, নির্বাচন আয়োজনের আগেই সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার শর্ত বিষয়টি রাজনীতির জটিলতায় নতুন প্রশ্ন তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সংস্কার ও বিচার যে কোনও নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য, এটি সত্যই। তবে এই কাজগুলো কতটা সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত হবে, তা নিয়ে দেশের নানা মহলে নানা আলোচনা চলছে। বিশেষ করে ‘জুলাই সনদ’ বা নির্বাচন সংক্রান্ত ঐকমত্য তৈরি ও বাস্তবায়নের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলীয় ঐক্যমত্য কতটুকু সম্ভব, তা বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ রাজনৈতিক বিভাজন ও অবিশ্বাস এই প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে।
লন্ডনে বসবাসরত বিএনপি নেতার দেশে ফিরতে বাধা নেই বলে জানালেও, রাজনৈতিক পরিবেশ ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া এটি কেবল নিছক ইচ্ছার বিষয় নয়। দেশে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার উত্তেজনা ও নিরাপত্তার প্রশ্ন এ নিয়ে চলমান আলোচনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারেক রহমানের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন দেশের গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডলের জন্য ইতিবাচক সংকেত হতে পারে।
এই বৈঠক ও সংবাদ সম্মেলন থেকে একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত নয়, বরং বহুপক্ষীয় রাজনৈতিক সংলাপের প্রয়োজনীয়তার কথা স্পষ্ট হয়েছে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সকল রাজনৈতিক শক্তির ঐক্যের ডাক উচ্চারণ করা হলেও বাস্তবায়নের পথে এখনও অনেক বাধা রয়ে গেছে। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের স্বায়ত্তশাসন, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
যদিও দুই পক্ষ ‘নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট’ বলে প্রকাশ করেছেন, তবুও দেশের হাজারো মানুষের কাছে এই সন্তুষ্টি কতটা আত্মতৃপ্তিকর, তা ভাবনার বিষয়। দেশের সবার জন্য সমান ও ন্যায়সঙ্গত নির্বাচনের ব্যবস্থা করার জন্য শুধু কথার নয়, বাস্তব পদক্ষেপের প্রয়োজন। নির্বাচনকে রাজনৈতিক যুদ্ধের মঞ্চ নয়, বরং গণতন্ত্রের উজ্জ্বল উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এ পথে অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের মতো ব্যক্তিদের আন্তরিক উদ্যোগ অবশ্যই স্বাগত, কিন্তু দেশের দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতার জন্য দরকার সকল রাজনৈতিক পক্ষের সম্মিলিত সংকল্প ও দায়বদ্ধতা।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের এই সংকটময় সময়ে, নতুন নির্বাচনের ঠিকানা এবং রাজনৈতিক সংস্কার দেশবাসীর চোখে এক নতুন আশা জাগাচ্ছে, যা সফল ও সুফল বয়ে আনুক সেটাই প্রত্যাশিত।
