বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
Natun Kagoj

চিকুনগুনিয়া: এক উপেক্ষিত মহামারির পথে ঢাকা

চিকুনগুনিয়া: এক উপেক্ষিত মহামারির পথে ঢাকা
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

চিকুনগুনিয়া—একটি ভাইরাসঘটিত রোগ, যার মৃত্যুহার হয়তো খুব বেশি নয়, কিন্তু দুর্ভোগের মাত্রা অত্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি ও গভীর। জ্বর ও গিঁট ব্যথা দিয়ে শুরু হয়ে এই রোগ অনেক সময় রোগীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ছিনিয়ে নেয় মাসের পর মাসের জন্য। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এমন একটি রোগ যখন রাজধানী ঢাকায় ভয়াবহ হারে ছড়িয়ে পড়ছে, তখনও সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এর পরীক্ষাই কার্যত বন্ধ!

২০১৭ সালের প্রাদুর্ভাবের পর চিকুনগুনিয়াকে ‘কম গুরুত্বের’ রোগ হিসেবে চিহ্নিত করে সরকারি হাসপাতালগুলোতে এর পরীক্ষা প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়, শুধু এ কারণেই যে এতে “মৃত্যু কম”। অথচ সাম্প্রতিক জরিপ ও গবেষণা বলছে ভিন্ন কথা। আইসিডিডিআর,বি এর সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, পরীক্ষাকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৮২ শতাংশ আক্রান্ত হচ্ছেন এই ভাইরাসে। এটি মহামারির আলামত, কোনো সাধারণ প্রাদুর্ভাব নয়।

সরকারি কর্মকর্তারা যুক্তি দিচ্ছেন, কিট অপচয় এড়াতেই পরীক্ষা সীমিত রাখা হয়েছে। এটি এমন এক বাস্তবতা যেখানে রোগী এক হাসপাতাল থেকে আরেকটিতে ঘুরেও পরীক্ষা করাতে পারছেন না, অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, কিট রাখলে হয়তো নষ্ট হয়ে যাবে! প্রশ্ন হলো, পরীক্ষা না করেই কিভাবে রোগ শনাক্ত করবেন চিকিৎসকরা? বিশেষ করে যখন চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর উপসর্গ প্রায় মিলেও যেতে পারে, তখন সুনির্দিষ্ট পরীক্ষাই রোগের ধরন ও চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণে মুখ্য হওয়া উচিত।

চিকিৎসা নয়, প্রতিরোধই হওয়া উচিত ভাইরাসবাহিত রোগের মূল কৌশল। কিন্তু সেই প্রতিরোধ ব্যবস্থার মেরুদণ্ড, মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। সিটি করপোরেশনের ইনসেকটিসাইড ব্যবহারে সক্রিয় উপাদানের উপস্থিতি, প্রয়োগ পদ্ধতি, ও বাহকভিত্তিক কৌশলের কোনো বৈজ্ঞানিক যাচাই নেই বলেই জানিয়েছেন কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা। “বন্দুক আছে, গুলি নেই” এই উপমা শুধু মশা নয়, পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থারই প্রতিচ্ছবি।

গবেষণায় দেখা গেছে, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত একজন রোগী গড়ে হারাচ্ছেন ১০ দিন কর্মদিবস, যার প্রত্যক্ষ আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৮ হাজার টাকা। স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য এই ক্ষতি শুধু অর্থনৈতিক নয়, পরিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তাও হুমকির মুখে ফেলে।

যখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, “চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসা উপসর্গের ওপর ভিত্তি করেই যথেষ্ট” তখন তা এক ধরনের আত্মতুষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়। উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা তখনই কার্যকর, যখন নিশ্চিতভাবে জানা যায় রোগটি কী। না হলে চিকিৎসা ‘চেষ্টা ও ভুল’-এর পরীক্ষাগারে পরিণত হয়, যার খেসারত দিতে হয় রোগীকে।

আমরা যদি এখনই সঠিক উদ্যোগ না নেই, তাহলে এই “নীরব মহামারি” কেবল ঢাকায় নয়, ঈদ পরবর্তী গণপরিভ্রমণের ফলে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু একসঙ্গে সংক্রমিত হলে চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর চাপ আরও দ্বিগুণ হবে।

প্রয়োজন এখন সরকারি হাসপাতালে চিকুনগুনিয়া পরীক্ষার অবিলম্বে পুনরায় চালু করা, মশা নিয়ন্ত্রণে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণভিত্তিক কার্যকর ইনসেকটিসাইড প্রয়োগ, বাহকভিত্তিক প্রতিরোধ কৌশল বাস্তবায়ন, জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার, স্বাস্থ্য খাতে দূরদর্শী পরিকল্পনা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

চিকুনগুনিয়া মৃত্যুর কারণ না হলেও, এটি জীবনের মান নষ্ট করে। এটিকে আর হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। একজন নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব, দুই-ই যেন এখন ভুলে যাওয়ার পথে। সরকার, প্রশাসন এবং জনগণ, সবাইকে এখন জেগে উঠতে হবে, নইলে আগামী দিনগুলো হবে আরও বেদনার।


গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

সর্বশেষ