বিএম কনটেইনারকে অগ্নিনিরাপত্তায় দেশসেরা স্বীকৃতিস্বরূপ ট্রফি দিলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী!


২০২২ সালের ৪ জুন মাসে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বেসরকারি বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুনের পর ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। এ ঘটনায় আগুন নেভাতে যাওয়া ৯ জন ফায়ার ফাইটারসহ ৫০ জন মারা যান। আহত হন দুই শতাধিক। এই ঘটনার দাগ এখনো কাটেনি। সে দিনের ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা এখনো মানুষ আতঙ্কে উঠেন। বিস্ফোরণের এই ঘটনায় কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। জেলা প্রশাসকের তদন্ত কমিটিতে উঠে আসে ভয়াবহ এ ঘটনার চিত্র। দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হলেও এখন পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। অথচ সেই বিএম কনটেইনার ডিপোকে অগ্নিনিরাপত্তায় দেশসেরা স্থাপনা হিসেবে স্বীকৃতিস্বরূপ স্মার্ট গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ক্যাপ্টেন মাইনুল আহসানকে সেফটি এক্সিলেন্স-চ্যাম্পিয়ন ট্রফি তুলে দেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। যা দেখে দেশের মানুষের মাঝে কৌতুহলের শেষ নাই। প্রশ্ন উঠছে, বিএম ডিপোর এমন ভয়াবহ ঘটনার দাগ না কাটতেই কি করে অগ্নিনিরাপত্তায় দেশসেরা হয়?। অনেকের ভাষ্য, বিএম কন্টেইনার ডিপোকে অগ্নিনিরাপত্তায় দেশসেরা না দিয়ে মানুষ মারায় দেশসেরা স্বীকৃতি দেয়া উচিত ছিল। কেউ কেউ প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, বিএম কনটেইনার অগ্নিনিরাপত্তায় দেশসেরা নাকি হত্যাকারী হিসেবে দেশসেরা? এ প্রশ্নের উত্তর দিবে কে?
সোমবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘৯ম আন্তর্জাতিক ফায়ার সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি এক্সপো ২০২৪’ এ প্রতিষ্ঠানটিকে এ স্বীকৃতি দেয় ইলেকট্রনিক সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইসাব)।
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। স্মার্ট গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ক্যাপ্টেন মাইনুল আহসান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে সেফটি এক্সিলেন্স-চ্যাম্পিয়ন ট্রফি গ্রহণ করেন।
এসময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি জসিম উদ্দিন, সিনিয়র সহ-সভাপতি আমিন হেলালী উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সীতাকুণ্ডে অবস্থিত বিএম কনটেইনার ডিপোর অফ-ডক প্রাঙ্গণে এমন বিশ্বমানের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পর্ষদকে বিশেষভাবে প্রশংসা করেন।
এদিন ইসাব চারটি বিভাগে (যেমন আবাসিক ভবন, বাণিজ্যিক ভবন, শিল্প-আরএমজি ও শিল্প-অন্যান্য) নিরাপত্তা শ্রেষ্ঠত্ব পুরস্কার ঘোষণা করে। বিচারক প্যানেল ছিলেন বুয়েট, কুয়েটের অধ্যাপক ও দেশসেরা স্থপতিরা।
বিএম কনটেইনার ডিপো বাংলাদেশের প্রথম শিল্প যেখানে সাধারণ ফায়ার ডিটেকশন, ফায়ার হাইড্রেন্ট ও স্প্রিংকলার সিস্টেম ছাড়াও এর পুরো ২৪ একর ইয়ার্ড এবং ওয়ারহাউজ এলাকায় অ্যালকোহল প্রতিরোধী ফোম ফায়ারফাইটিং সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে।
সব ধরনের বিপজ্জনক পণ্য হান্ডলিং করার জন্য আইএমডিজি কোড অনুসারে রাসায়নিক সুরক্ষা বাড়াতে অফ-ডক ডিপোটির ওয়ারহাউজগুলোতে ৩০০টি রাসায়নিক ডিটেক্টরও স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও ডিপোটিতে নিজস্ব ফায়ার ব্রিগেড রয়েছে যাদের নেতৃত্বে আছেন ফায়ার সার্ভিসের একজন সাবেক কর্মকর্তা। এমন সংবাদ দেখার পরে ফায়ার সার্ভিসের অনেক কর্মী বুকফাটা কষ্ট চেপে রেখে বলেন, আমাদের ফায়ার কর্ীত রা আগুন নিভাতে গিয়ে মারা গিয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের অনেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিএম ডিপোকে এমন স্বীকৃতি দিতে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, তার ভাই আনিছ ও উপপরিচালক জসিম উদ্দিন কয়েক লক্ষ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। আন্তর্জাতিক ফায়ার সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি এক্সপো নামে যে প্রোগ্রাম হয় তা মহাপরিচালকের টাকায় করেন ইলেকট্রনিক সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইসাব)। এই সংগঠনটি নামে মাত্র অনুষ্ঠানের আয়োজক। এর মূলে সব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাইন উদ্দিন। ডিজির তালিকা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অগ্নিনিরাপত্তায় দেশসেরা স্বীকৃতি দেয়া হয়।
সেই তদন্ত কমিটি রিপোর্টে কি আছে? কারা ছিলেন তদন্ত কমিটিতে:
চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোর বিস্ফোরণের ঘটনায় ডিপো কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার গঠিত তদন্ত কমিটি। একই সঙ্গে ডিপোগুলোর কার্যক্রম তদারকিতে নিয়োজিত ২৫ সংস্থার সমন্বয়হীনতার বিষয় উঠে এসেছে তদন্ত প্রতিবেদনে। ডিপোগুলোতে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে ২০ দফা সুপারিশ তুলে ধরেছে কমিটি।
৫ জুন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত ৯ সদস্যের তদন্ত কমিটি বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিনের কাছে ১৯ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। এ সময় বিভাগীয় কমিশনার প্রতিবেদন বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনা সম্পর্কে সরকারের সর্বোচ্চ মহল অবগত। আমরা এই তদন্ত প্রতিবেদক সরকারের উচ্চপর্যায়ে জমা দেব।’
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনাকালে কমিটির সদস্যরা দুর্ঘটনাস্থল বিএম কন্টেইনার ডিপো ও ডিপোতে থাকা হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আল রাজী কেমিক্যালস ইন্ডাস্ট্রি সরেজমিন পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা বিএম কন্টেইনার ডিপো ও আল রাজী কেমিক্যালসের দুই মালিক মোস্তাফিজুর রহমান ও মুজিবুর রহমানসহ মোট ২৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তবে বিএম কন্টেইনার ডিপোর দুই গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা নির্বাহী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জিয়াউল হায়দার ও জিএম মার্কেটিং নাজমুল আকতার খানের কাছে তদন্ত কমিটি নোটিস পাঠালেও তারা দুজন কমিটির কাছে সশরীরে হাজির হয়ে লিখিতভাবে কোনো বক্তব্য দেননি। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জিয়াউল হায়দার বিএম কন্টেইনার ডিপোতে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। গত ৩১ মে সর্বশেষ তিনি ডিপোতে যান। আর নাজমুল আকতার খান দুর্ঘটনার পর পুলিশের দায়ের করা মামলার আসামি।
বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোগুলোর কার্যক্রম তদারকির দায়িত্বে থাকা কাস্টমস, চট্টগ্রাম বন্দর, পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স, নৌপরিবহন অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থার তদারকি কার্যক্রম এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে ডিপো কর্তৃপক্ষের কমপ্লায়েন্স কার্যক্রমের প্রতিবেদনও পর্যালোচনা করে তদন্ত কমিটি।
ঘটনার পর বিভিন্ন মহল থেকে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবুর রহমানের মালিকানার বিষয়টি গৌণ করে দেখানোর চেষ্টা করা হলেও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে মুজিবুর রহমান ও তার ভাই মোস্তাফিজুর রহমানকে বিএম ডিপোর ৫১ শতাংশের ও আল রাজী কেমিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজের শতভাগ মালিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
১১৮টি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা দিয়ে মনিটরিং করা হতো পুরো কন্টেইনার ডিপো। সাতটি ডিজিটাল ভিডিও রেকর্ডিং (ডিভিআর) মেশিনে এসব তথ্য সংরক্ষণ করা হলেও মেশিনগুলো পুড়ে যাওয়ায় সিসিটিভির কোনো ফুটেজ পাওয়া যায়নি। তদন্তকালে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজের কোনো ব্যাকআপও পাওয়া যায়নি। যে কারণে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতসহ তদন্ত-সংশ্লিষ্ট অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। একটি বিদেশি অংশীদারিত্বের প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই যুগে প্রযুক্তিগতভাবে সংরক্ষিত তথ্যের কোনো ব্যাকআপ না থাকা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে। ভিডিও ফুটেজ না পেলেও ডিপোতে থাকা রাসায়নিক থেকেই আগুনের সূত্রপাত বলে মন্তব্য করেছে তদন্ত কমিটি।
প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, ‘মূলত তিনটি বিষয়কে সামনে রেখেই আমরা তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। এগুলো হলো বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের কারণ, দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ এবং এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়ন।’ তিনি বলেন ‘আমরা সরেজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী, ডিপোর মালিকপক্ষ, দায়িত্বশীল কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য নিয়েছি। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও সেখানকার দায়িত্বশীলদের বক্তব্য গ্রহণ করেছি। তদারকি সংস্থাগুলোর তদারকি কার্যক্রম ও ডিপোর কমপ্লায়েন্স কার্যক্রমও পর্যালোচনা করেছি। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় এনে আমরা তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছি। এতে আমরা ভবিষ্যতে ডিপোগুলোর সুষ্ঠু কার্যক্রম পরিচালনা, নিরাপত্তা নিশ্চিত ও অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা এড়াতে ২০ দফা সুপারিশ তুলে ধরেছি। তবে এটাই যে চূড়ান্ত তা নয়, এ ঘটনায় আরও বৃহত্তর তদন্তও হতে পারে।’
গত ৪ জুন রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে অবস্থিত বিএম কন্টেইনার ডিপোতে প্রথমে আগুন ও পরে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আগুন নেভাতে যাওয়া ৯ জন ফায়ার ফাইটারসহ ৫০ জন মারা যান। আহত হন দুই শতাধিক।
ঘটনা তদন্তে ৫ জুন ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিন। অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি জাকির হোসেন খান, কাস্টমস হাউজের অতিরিক্ত কমিশনার ডা. আবু নুর রাশেদ আহমেদ, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মুফিদুল আলম, সেনাবাহিনীর মেজর আবু হেনা মো. কাউসার জাহান, চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (পরিবহন) এনামুল করিম, ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক আনিসুর রহমান, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনী আকতার।
