বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
Natun Kagoj
আবদুল্লাহ আল মামুন

মহা দুর্নীতিবাজ এক উপসচিব!

মহা দুর্নীতিবাজ এক উপসচিব!
আবদুল্লাহ আল মামুন/ফাইল ছবি
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ স্পোর্টস কমপ্লেক্স ফর পিপল উইথ স্পেশাল নিডস (scpsn) প্রকল্প পরিচালক উপসচিব (ডিএস) আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের নজিরবিহীন দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

এ প্রকল্পে যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তাকে প্রকল্প পরিচালক হতে হবে এমন নিয়ম থাকলেও সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের সুপারিশে আবদুল্লাহ আল মামুনকে এই প্রকল্পে নিয়োগ দেওয়া হয়।

অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের জন্য একটি গাড়ি কেনা হলেও তিনি গাড়ি ভাড়ার নামে মাসে দুই লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এই প্রকল্পের ডিপিপিতে বরাদ্দকৃত টাকা তিনি বিভিন্ন ভুয়া বিল ও ভাউচারের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন। প্রকল্পের ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল অংশ শুরু হওয়ার আগেই তিনি তার ভাইকে নিয়োগ দেন।

সাবেক স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণপূর্ত বিভাগের অধীনে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, ফলক স্থাপন ও লজিস্টিক্যাল সাপোর্টের উদ্বোধন করেন। এসব কাজের ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে ১০ লাখ ১৭ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন আবদুল্লাহ আল মামুন।

এর আগে তিনি তেজগাঁও এসি ল্যান্ডের দায়িত্ব পালন করেন। সেখানেও তিনি নজিরবিহীন দুর্নীতি করেছেন। অনেক মিডিয়া তার দুর্নীতির খবর প্রকাশ করলেও সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রীর আশীর্বাদে তিনি পার পেয়ে যান।


তৎকালে তেজগাঁও এসি ল্যান্ড (সহকারী কমিশনার ভূমি) কার্যালয়ে প্রতিদিন যেসব ফাইল নথিভুক্ত হয়, তার বেশির ভাগ আদেশপত্রের (অর্ডারশিট) এক কোণে ১০,০০০, ১৫,০০০, ২০,০০০, ২৫,০০০, ৩০,০০০, ৩৫,০০০; আবার কখনো সংক্ষেপে ১০, ২০, ৩০, ৪০, ৫০, ১০০ প্রভৃতি সংকেত লেখা থাকে। যার পূর্ণাঙ্গ অর্থ হলো ১০ হাজার, ২০ হাজার, ৩০ হাজার, ৪০ হাজার, ৫০ হাজার এবং এক লাখ টাকা। আর এসব হচ্ছে ঘুষের পরিমাণ বোঝানোর সংকেত।

বেশির ভাগ ফাইলের ওপরই এভাবে ঘুষের অঙ্ক লেখা থাকে। স্বয়ং এসি ল্যান্ড আবদুল্লাহ আল মামুন তালুকদার নিজ হাতে ঘুষের অঙ্কগুলো লিখে দেন। জমির নামজারি কিংবা মিস কেস করতে আসা কোনো ব্যক্তি উল্লিখিত টাকা ঘুষ হিসেবে না দিলে তার ফাইল নামঞ্জুর করে গোডাউনের স্তূপে ফেলে রাখা হয়। এটাকে ভূমি প্রশাসনে নজিরবিহীন দুর্নীতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন নগরীতে কর্মরত একাধিক এসি ল্যান্ড। এ দুর্নীতির প্রমাণ এই প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।

তেজগাঁও এসি ল্যান্ড কার্যালয়ে মিস কেসের ক্ষেত্রে ঘুষের পরিমাণটা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। জমিসংক্রান্ত ছোটখাটো সমস্যা সংশোধনের জন্য দাখিল করা আবেদনকে মিস কেস বলা হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৫০ হাজার টাকার কমে কোনো মিস কেসের নিষ্পত্তি হয় না। সর্বোচ্চ ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে লেনদেন হয়। দাবিকৃত ঘুষ না পেলে মামলা নিষ্পত্তি না করে বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখা হয়।

এসি ল্যান্ড অফিসে কথা হয় মিস মামলার একাধিক বাদীর সঙ্গে। তাঁরা জানান, এসি ল্যান্ড কারো ফাইলের এক কোণে ৫০, কারো ফাইলে ৬০ হাজার টাকা ঘুষের সংকেত নিজ হাতে লিখে দিয়েছেন।

নামজারি করতে আসা একজন মহিলা জানান, অনেক কষ্টে পাঁচ হাজার টাকা জোগাড় করে তিনি এসি ল্যান্ডের হাতে দেন। ঘুষের টাকা কম হওয়ায় এসি ল্যান্ড রেগে যান। উল্টো ওই মহিলার বিরুদ্ধে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ তুলে তাকে অফিসে আটকে রাখা হয়। পরে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে তিনি ছাড়া পান। এটি গত মার্চের ঘটনা।

সম্প্রতি বেশ কয়েক দিন তেজগাঁও এসি ল্যান্ড অফিসে গিয়ে এমন শত শত ভুক্তভোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে, যারা মাসের পর মাস ঘুরেও তাদের জমির নামজারি সম্পন্ন করতে পারছেন না। মোটা অঙ্কের ঘুষ না দিতে পারার কারণে এ হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা।

তেজগাঁও কুনিপাড়ার বাসিন্দা হামিদুল হক বলেন, নামজারির ক্ষেত্রে সরকারি খরচ আড়াই শ’ টাকা হলেও তার কাছে ২০ হাজার টাকা দাবি করা হচ্ছে। এ ঘুষ দিতে পারেননি বলে তার ফাইল নামঞ্জুর করা হয়েছে। এর কারণ জানতে চাইলে এসি ল্যান্ড তাকে অপমান করে রুম থেকে বের করে দেন বলে হামিদুল অভিযোগ করেন।

তেজগাঁও রাজস্ব সার্কেলের এসি ল্যান্ড স্বাক্ষরিত বেশ কিছু আদেশপত্র প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। প্রতিটি আদেশপত্রে এসি ল্যান্ড নিজেই ঘুষের পরিমাণ লিখে দিয়েছেন।

দেখা গেছে, ২৩৬১/১২-১৩ নম্বর ফাইলের আদেশপত্রে ৩০ হাজার, ২৩০৪/১২-১৩ নম্বরে ২০ হাজার, ২৫৬৬/১২-১৩ নম্বরে ২০ হাজার, ২২০৩ নম্বরে ৫০ হাজার, ২৪৭৬/১২-১৩ নম্বরে ৩০ হাজার, ৪১৩২/১২-১৩ নম্বরে ১৫ হাজার, ৪১০৯/১২-১৩ নম্বরে ১৫ হাজার, ৪১৭০/১২-১৩ নম্বরে ১৫ হাজার, ৪১৬৭/১২-১৩ নম্বরে ৩৫ হাজার, ২৪১০/১২-১৩ নম্বরে ৩০ হাজার, ২৪৯২/১২-১৩ নম্বরে ১৫ হাজার এবং ২৪৭৮/১২-১৩ নম্বর ফাইলের আদেশপত্রে ১০ হাজার টাকা লিখা রয়েছে। যারা সংকেত অনুযায়ী ঠিকমতো ঘুষ দিয়েছেন তাদের ফাইল মঞ্জুর হয়েছে, যারা দেননি তাদের ফাইল নামঞ্জুর করে গোডাউনে ফেলে রাখা হয়েছে বলে একাধিক জমির মালিক অভিযোগ করেন।

অর্ডারশিটে সংক্ষেপে টাকার অঙ্ক লিখে দিয়ে কিংবা মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে ঘুষ আদায়ের বিষয়টি নিয়ে ভূমি প্রশাসনে রীতিমতো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ বিষয়টিকে নজিরবিহীন হিসেবেও উল্লেখ করছেন। কারণ এর আগে আর কোনো এসি ল্যান্ড এভাবে দালিলিক প্রমাণ রেখে ঘুষ আদায় করেননি। ঘুষ নেওয়ার ঘটনা প্রকাশ্যে ঘটলেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে এসি ল্যান্ডের সুসম্পর্ক থাকায় বিষয়টি নিয়ে কেউ ঘাঁটাঘাঁটি করতে সাহস পাচ্ছেন না বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা মন্তব্য করেন।

একজন এসি ল্যান্ড এ প্রতিবেদককে বলেন, “এসি ল্যান্ডের চাকরিটা সেবামূলক। বিতর্ক সৃষ্টি হয় এমন কোনো কাজ এসি ল্যান্ডের করা উচিত না। ”

অভিযোগ পাওয়া গেছে, শুধু সাধারণ ভূমি মালিক নন, ভূমি প্রশাসনে কর্মরতদের কাছ থেকেও কাঙ্ক্ষিত ঘুষ না পেলে এসি ল্যান্ড কোনো কাজ করেন না। তার অফিসে কর্মরত কেউ সাধারণ একটি নামজারি ফাইল জমা দিলেও ফাইলপিছু ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা দাবি করেন তিনি। কেউ এ ব্যাপারে কথা বললে তিনি সরাসরি বলে দেন, “সবাই ঘুষ খায়। তাকে দিতে অসুবিধা কোথায়!”

বাংলাদেশ জরিপ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা রাজু আহমেদ তার নিজের একটি ফাইল নামজারি করার জন্য জমা দিলে তহসিলদার, কানুনগো, সার্ভেয়ার সবাই যাচাই-বাছাই করে কাগজপত্র সঠিক আছে বলে মতামত দেন। কিন্তু এসি ল্যান্ড তার চাহিদামতো ঘুষ পাননি বলে সেই ফাইল (নামজারি নম্বর ৫০০৭/১২-১৩) নামঞ্জুর করে ফেলে রাখেন।

অভিযোগ উঠেছে, নগরীর অন্য কোনো এসি ল্যান্ডও তাদের স্বজনদের নামজারির জন্য তেজগাঁও রাজস্ব সার্কেলে ফাইল জমা দিলে সেগুলোও ঘুষ না পেলে মঞ্জুর করেন না আবদুল্লাহ আল মামুন তালুকদার। একাধিক এসি ল্যান্ড নাম প্রকাশ না করে এমন অভিযোগ করেছেন।

দাবি অনুযায়ী ঘুষ দিয়েছেন এমন একাধিক ভুক্তভোগী জানান, বর্তমান তেজগাঁওয়ের এসি ল্যান্ড নিজ হাতে ঘুষ নেন। ঘুষ ছাড়া কোনো ফাইল তিনি মঞ্জুর করেন না। তার চাহিদা মেটাতে না পারলে নানা অজুহাতে তিনি ফাইল আটকে রাখেন। এর ফলে প্রতিদিন তার অফিসে সেবাপ্রার্থীদের ব্যাপক ভিড় জমে।

সাঁতারকুল এলাকার বাসিন্দা হাসনা বেগম জানান, তিনি তিন মাস ধরে এসি ল্যান্ড অফিসে ঘুরছেন। মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে না পারায় তিনি নামজারি শেষ করতে পারছেন না। অথচ এই নামজারি শেষে তিনি জমি বিক্রি করে অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা করাবেন।

ঢাকায় কর্মরত কয়েকজন এসি ল্যান্ড বলেন, “ভূমি অফিসে ঘুষ লেনদেনের ব্যাপারটি নতুন নয়; কিন্তু আদেশপত্রে নিজ হাতে সংকেত দিয়ে ঘুষ আদায় করার বিষয়টি নজিরবিহীন। ”

ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, সাবেক এসি ল্যান্ড তেজগাঁও রাজস্ব সার্কেলে যোগদানের পর থেকে সেবাপ্রার্থীদের হয়রানি চরম আকার ধারণ করেছে। এই সার্কেলের ফাইলেই সে প্রমাণ রয়েছে। দাখিল করা ফাইলের মধ্যে ৮০ শতাংশ নানা অজুহাতে আটকে রাখা কিংবা নামঞ্জুর করে গোডাউনে ফেলে রাখা হয়। এতে এই সার্কেলে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে বিপর্যয় নেমে এসেছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তহসিলদার (সহকারী ভূমি কর্মকর্তা) বাংলানিউজকে জানান।

অভিযোগ রয়েছে, সাবেক এই এসি ল্যান্ড ঢাকা জেলা প্রশাসক ও ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে সুসম্পর্কের কথা বলে তার দপ্তরকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন। কথায় কথায় তিনি তাদের নাম আওড়ান বলে মন্তব্য করেন নামজারি করতে আসা ভুক্তভোগী ইসমাইল হোসেন ইমু।

অনুসন্ধানে জানা যায়, অফিসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি আবদুল্লাহ আল মামুন এসি ল্যান্ড থাকাকালে তার বাসায় নিয়ে যেতেন। বাসায় বসে ফাইলের গুরুত্ব বুঝে তিনি ঘুষের পরিমাণ নির্ণয় করতেন। তার এ কাজে সহযোগিতা করতেন বিশ্বস্ত কয়েকজন এমএলএসএস ও উমেদার (বহিরাগত সহকারী)। তারা ফাইলে উল্লিখিত আবেদনকারীদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে এসি ল্যান্ডের পক্ষে ঘুষ নেওয়ার দেন-দরদার করে থাকেন।

কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, ফোনে বলে দেওয়া হয় কত টাকা ঘুষ দিতে হবে। এসি ল্যান্ডের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ হলো, তিনি মধ্যরাত পর্যন্ত অফিসে থাকেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও কর্মচারীদের অফিসে হাজির থাকতে বাধ্য করেন। সে সময় বেশ কয়েক দিন সরেজমিনে তেজগাঁও এসি ল্যান্ড অফিসে গিয়ে এর সত্যতা পাওয়া গেছে।


গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

আরও পড়ুন