শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫
Natun Kagoj
সাবেক এলজিইডি মন্ত্রী’র পরিচয়ে পিডি নিয়োগ;

উন্নয়ন প্রকল্পে চলছে হরিলুট!

উন্নয়ন প্রকল্পে চলছে হরিলুট!
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)-এ প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে নানা অনিয়ম ও দলীয়করণের অভিযোগ উঠেছে। এসব প্রকল্প পরিচালকের মধ্যে বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ মতাদর্শের অনুসারী ছিলেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকারের পতনের পর বিভিন্ন সেক্টরে রদবদল হলেও আওয়ামী সুবিধাভোগী এসব প্রকল্প পরিচালকরা এখনও স্বপদে বহাল রয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এদের কিছু সহযোগিতা করছেন জুলাই-আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে রাস্তায় মিছিলে অংশ নেওয়া অধিদপ্তরের এক শ্রেণির কর্মকর্তা ও কর্মচারী।

জানা যায়, এলজিইডিতে প্রকল্প তৈরি ও পরিচালনায় সহায়তাকারী দক্ষ কর্মকর্তাদের পরবর্তীতে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতো। তবে, বিগত সরকার এই নিয়ম অনুসরণ না করে, দলীয় আনুগত্য প্রদর্শনকারী কম যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মকর্তাদেরও এই পদে নিয়োগ দেয়।

এলজিইডির আওতায় ৬০২ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৬ হাজার ৩শ কোটি টাকা) বাজেটের নগর পরিচালন ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প আইইউজিআইপি-এর প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন গাজীপুর জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল বারেক নিয়োগ পান। সূত্রমতে, বিগত সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী তাজুল ইসলামকে ৫ কোটি টাকা উৎকোচ প্রদান করে তিনি এই পদে নিয়োগ লাভ করেন।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এলজিইডির তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী সেখ মোহাম্মদ মহসিনের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানো অভিযোগপত্রে প্রকল্প পরিচালক আব্দুল বারেকের নাম উঠে আসে। অভিযোগে বলা হয়, অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক পদে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োগ না দিয়ে জুনিয়র প্রকৌশলীদের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যেখানে প্রধান প্রকৌশলী সেখ মোহাম্মদ মহসিন সুপারিশ করেছিলেন। এসব নিয়োগের বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা গ্রহণ করা হয়েছে। টাকার বিনিময়ে এডিবি রক্ষণে বাস্তবায়িত আইইউজিআইপি প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে গাজীপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল বারেককে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেখানে অভিজ্ঞতা ও জ্যেষ্ঠতার বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে। প্রকল্পের কাজেও অনিয়ম এবং অর্থ লোপাটের মতো ঘটনা ঘটেছে।


এলজিইডির একজন সহকারী প্রকৌশলী জানান, "বারেক স্যারের সাথে মন্ত্রী তাজুল ইসলামের সখ্যতার বিষয়টি ভবনে সবারই জানা। গত সরকারের সময়ে তিনি নিজেই এটি বারবার বলতেন। তবে এখন তিনি টাকা-পয়সা দিয়ে আওয়ামী বিরোধী নেতাদের সাথে সমঝোতা করে চলছেন।"

অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন পৌরসভার জন্য বরাদ্দকৃত কাজের প্রাক্কলন, দরপত্র অনুমোদন এবং বিল প্রদানের সময় সংশ্লিষ্ট পৌরসভা কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদারের কাছ থেকে ১-২ শতাংশ কমিশন আদায় করা হত। এই কাজ পিডি আব্দুল বারেক নিজে না করে, হিসাব শাখার কর্মরত হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা মাণিক লাল কুন্ডের মাধ্যমে আদায় করতেন। এ ক্ষেত্রে তাকে সহায়তা করেন হিসাব রক্ষক মোঃ রিয়াজ উদ্দিন, হিসাব রক্ষক মোঃ আরিফুল আক্তার টুটুল এবং এলকেএসএস এর হিসাব রক্ষক মতিন।

প্রকল্পের আওতায় দরপত্র প্রক্রিয়াতেও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আতাতের মাধ্যমে তিনি এসব টেন্ডার নির্দিষ্ট ঠিকাদারকে পাইয়ে দেন। এ প্রকল্পের আওতায় যশোরের কেশবপুর পৌরসভার ৫টি দরপত্রের সবগুলো কাজ পায় MOZAHAR ENTERPRISE (PVT) & JV BANNANTAR TRADING LTD নামের একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এছাড়া আলমডাঙ্গা, গাংনীসহ অন্যান্য পৌরসভাগুলোর ক্ষেত্রেও এ প্রকল্পের আওতায় একই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে।

প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগেও একাধিক অভিযোগ রয়েছে। কুষ্টিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা ঠিকাদার আবুল কালাম আজাদের স্ত্রী রিমা খাতুন, যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও জিআইসিডির ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট-১ হিসেবে চাকরি পেয়েছেন। এছাড়া, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগে মোটা অঙ্কের ঘুষ আদায় এবং স্বজনপ্রীতির ঘটনা ঘটেছে। এ কাজে প্রকল্প পরিচালক আব্দুল বারেককে সহায়তা করেছেন তার গাড়ির ড্রাইভার আল-আমিন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রকল্পের একজন কর্মচারী জানান, "পিডি স্যারের সব কাজের সাথেই ড্রাইভার আল-আমিন জড়িত। ড্রাইভার হলেও তিনি সারাদিন প্রকল্প অফিসেই অবস্থান করেন।"

এসব বিষয়ে নগর পরিচালন ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক আব্দুল বারেকের সাথে কথা বলতে তার অফিসে গেলে, অফিস কক্ষে তার ড্রাইভার আল-আমিনকে পাওয়া যায়। এ সময় কক্ষে উপস্থিত আরেকজন ব্যক্তি নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে প্রকল্প পরিচালকের পক্ষে এ প্রতিবেদককে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। সাংবাদিক পরিচয়দানকারী ওই ব্যক্তিকে তার কর্মস্থলের নাম জানতে চাইলে, তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক আব্দুল বারেক বলেন, "প্রকল্পের সব কিছু নিয়মমতোই চলছে। আমি কাউকে ঘুষ দিয়ে এ পদে বসিনি।" একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান একটি পৌরসভায় সবগুলো কাজ কীভাবে পায়, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, "ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এক হলেও তারা লাইসেন্স ভাড়া নিয়ে কাজগুলো ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে করে থাকে।"


সরকার পতনের পর এলজিইডি প্রকৌশলীদের মধ্যে প্রত্যাশা ছিল যে, আওয়ামী সুবিধাভোগীরা অপসারিত হবেন, কিন্তু সরকারের পতনের ৮ মাস পেরিয়ে গেলেও তারা এখনও দায়িত্বে বহাল রয়েছেন। এই সময়ে কিছু প্রকল্প পরিচালকের পদ পরিবর্তন করা হলেও, বেশিরভাগ প্রকল্প পরিচালক পদে এখনও রয়েছেন ফ্যাসিস্টের সহায়করা।


নতুন/কাগজ/এলজিইডি/নিপ্র
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

আরও পড়ুন