ডিপিডিসিতে স্বৈরাচারের দোসররা: আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ


ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)-এর মধ্যে কিছু ব্যক্তির স্বৈরাচারি আচরণ এবং তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি কারনে প্রতিষ্ঠানটি আজ ধ্বংসের ধারপ্রান্তে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে পরিচিত, তারা নিজেদের ক্ষমতাকে বেআইনি বা অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়িয়ে তুলেছেন। ক্ষমতায় অত্যধিক আসক্ত হয়ে, কেবল নিজেদের স্বার্থে বা স্বার্থান্বেষী উদ্দেশ্যে তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। এ ধরনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কারণে গ্রাহকরা অবহেলিতভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সরকারের এই স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটি থেকে নানা পন্থায় অর্থ লোপাট করে তারা আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গত ১৬ বছরে সুবিধা নেয়া ডিপিডিসির কর্মকর্তারা নিজেকে রক্ষা করতে ভোল পাল্টিয়ে বিএনপি’র তকমা লাগিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকার আমলে যে কর্মকর্তারা দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।
সারাদেশে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান হলেও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে (ডিপিডিসি) এর ছোঁয়া লাগছে না। বরং দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ব্যক্তিরাই থাকছেন প্রতিষ্ঠানটির চালকের দায়িত্বে। এ নিয়ে ডিপিডিসির ভেতরে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে ডিপিডিসি পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে সংস্থাটির দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের অপসারণ ও শাস্তির দাবি জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী প্রকৌশলী পরিষদ।
এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) শফিকুল ইসলাম, জিটুজির প্রকল্প পরিচালক ফজিলাতুন্নেছা, জিটুজি প্রজেক্টের নির্বাহী প্রকৌশলী রাজিবুল হাদী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (এসি) মোহাম্মদ সাহেদ বিশ্বাস, ও ব্যবস্থাপক হুজ্জাত উল্লাহ সহ আরো বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা।
জিটুজি প্রকল্প পরিচালক ফজিলাতুন্নেছা
ডিপিডিসির সর্বেসর্বা হিসেবে পরিচিত ফজিলাতুন্নেছা, তার দাপটে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে এক শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছেন। তিনি তার ক্ষমতার মাধ্যমে নানা সুবিধা লাভ করেছেন এবং প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা ও প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে নিজের স্বার্থে কাজ করেছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে সংস্থার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেছেন এবং অনিয়মের মাধ্যমে সুবিধা নিয়ে ডিপিডিসিতে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। ফজিলাতুন্নেছার এসব কর্মকাণ্ডের কারণে ডিপিডিসির অভ্যন্তরে নানা সমস্যা ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠে এসেছে।
জি টুজি প্রকল্পে ব্যাপক পরিমাণে মালামাল কেনা হলেও সেগুলোর ব্যবহারের হার ছিল অত্যন্ত কম। ব্যবহার না হওয়ার সত্ত্বেও কোটি কোটি টাকার বিল পরিশোধ করা হয়েছে, যা প্রকল্পের আর্থিক অব্যবস্থাপনাকে নির্দেশ করে। এই অনিয়মের পেছনে ফজিলাতুন্নেছা এবং হাদীর সহযোগিতায় প্রকল্পের প্রচুর ক্যাবল চুরির ঘটনা ঘটেছে, যা প্রকল্পের সম্পদের অপব্যবহার এবং দুর্নীতির ইঙ্গিত দেয়। এর ফলে সরকারী অর্থের ক্ষতি হয়েছে এবং প্রকল্পের বাস্তবায়নেও বাধা সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৩ সালে এই প্রকল্পের মালামাল ক্রয়ে ব্যাপক দুর্নীতি ধরা পড়ে একটি বিভাগীয় তদন্তে। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, জার্মানি থেকে পণ্য কেনার কথা থাকলেও বাস্তবে তা চীনা পণ্য আনা হয়েছে। এর ফলে ডিপিডিসি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লাভবান হন কিছু কর্মকর্তা, যাদের মধ্যে ফজিলাতুন্নেছা অন্যতম। অসংখ্য অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রকল্পের শুরু থেকে এখনো তিনি তার পদে বহাল রয়েছেন। জিটুজি প্রকল্পের ফজিলাতুন্নেছা প্রায়ই ক্ষমতার লড়াইয়ে জয়ী হন। সরকার পরিবর্তন কিংবা অন্য কোনো পরিবর্তন সত্ত্বেও তিনি তার অবস্থান ধরে রেখেছেন, যা তার অদৃশ্য ক্ষমতার পরিচায়ক। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিনি অন্যতম সুবিধাভোগী হয়ে থাকলেও এখনো তার চাকরি অক্ষুণ্ণ।
১৩২ কেভি ক্যাবলের ক্রস বন্ডিং জয়েন্টসমূহের বিষয়ে প্রকল্পের দলিল এবং পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছিল যে, এই মালামালগুলি জার্মানিতে ম্যানুফ্যাকচার ও প্যাকেজিং করে পোল্যান্ড থেকে শিপমেন্ট করা হবে। কিন্তু সরেজমিনে দেখা গেছে যে, প্রকৃতপক্ষে এসব মালামাল চায়না থেকে শিপমেন্ট করা হয়েছে। এটি পিএসআই রিপোর্ট এবং অনুমোদিত জিটিপির স্পষ্ট ব্যত্যয়, যা প্রকল্পের নীতি এবং নির্ধারিত নিয়মের বিরুদ্ধে যায়। এই ধরনের অসঙ্গতি প্রকল্পের স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতায় বড় ধরনের প্রশ্ন তুলেছে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এ প্রকল্পে পরামর্শদাতা নিয়োগ করা হয়েছিল অধিকতর টেকনিক্যাল সার্ভিস গ্রহণের জন্য। পরামর্শকদাতা প্রকল্পের জন্য পিএসআই/ফ্যাট/পিএলআই সংক্রান্ত বিষয়ে মতামত এবং পরামর্শ প্রদান করেন এবং তার ভিত্তিতেই প্রকল্প দপ্তর থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তবে বর্ণিত মালামালসমূহের পিএসআই/ফ্যাট পরামর্শকদাতার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়েছে, কিন্তু প্রকল্পের পরামর্শকদাতা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয় মর্মে মতামত প্রদান করেছেন। এটি প্রকল্পের কার্যক্রমে আরও এক ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করেছে, যেখানে পরামর্শকদাতা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মতবিরোধ উঠে এসেছে, যা প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতায় প্রশ্ন তুলেছে।
অভিযোগ রয়েছে, ৪৫তম শিপমেন্টের মতো একইভাবে ২৩তম ও ৪৩তম শিপমেন্টের ক্ষেত্রেও অনুরূপ পরিস্থিতি ঘটেছে। এসব শিপমেন্টের মালামালগুলো পরামর্শকদাতা বা পিএলআই কমিটির গ্রহনের সুপারিশ ছাড়াই প্রকল্প দপ্তর কর্তৃক গ্রহণ করা হয়েছে এবং বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি, এসব মালামাল সাইটে ব্যবহৃতও হয়েছে।
কমিটির অনুসন্ধানে জানা যায় যে, ২৪তম ও ৪৩তম শিপমেন্টের ক্ষেত্রেও একইভাবে জার্মানির পরিবর্তে চায়না থেকে শিপমেন্ট করা হয়েছে। জিটুজি প্রকল্পের ৪৫তম শিপমেন্টে ১৩২ কেভি ক্যাবল আনুষাঙ্গিক মালামাল সম্পর্কিত ২০২২ সালের ১লা নভেম্বর পোস্ট ল্যান্ডিং পরিদর্শনে দেখা যায় যে, ইপিসি চুক্তি এবং অনুমোদিত জিটিপি এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে, মালামালগুলো জার্মানি থেকে শিপমেন্ট না করে চায়না থেকে পুনরায় প্যাকেজিং এবং শিপমেন্ট করা হয়েছে। এই মালামালসমূহ জিটুজি প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ রাজিবুল হাদী ও অপর এক কর্মকর্তার মাধ্যমে পিএলআই করে গ্রহণ করা হয়। এর ফলে, ৬০ কোটি টাকার মালামাল জার্মানির পরিবর্তে চায়না থেকে আনা হয়। সাধারণত, চায়নার মালামাল ইউরোপ (জার্মানি) এর মালামালের চেয়ে ২০-৩০% সস্তা হয়, ফলে প্রকল্পের কিছু কর্মকর্তা প্রায় ১২ কোটি টাকা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন এবং এতে পাবলিক মানির অপব্যবহার ঘটেছে।
ডিপিডিসির কালো টাকায় গড়ে ওঠা সম্পদের পাহাড়
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের জিটুজি প্রজেক্টের নির্বাহী প্রকৌশলী রাজিবুল হাদী। এই কর্মকর্তা ডিপিডিসির কালো টাকায় গড়ে ওঠা সম্পদের পাহাড়ের মালিক। ডিপিডিসির ‘মোস্ট করাপটেড’ হিসেবে পরিচিত হাদী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে নানা অনিয়মের মাধ্যমে পাহাড়প্রমাণ সম্পদ গড়েছেন। তবে ক্ষমতার ছায়ায় থাকায় তার ওপর কোনো কিছুই প্রভাব ফেলতে পারে না, এবং টাকার জন্যই তিনি সব কিছু করেন।
জানা গেছে, রাজিবুল হাদী দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন। তিনি ডিপিডিসির বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ এবং শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের বিপুল পরিমাণ অর্থের লোপাটের সাথে জড়িত। দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন তিনি।
ছাত্রজীবনে যশোরে ক্যাডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ওয়ান ইলেভেনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করেন এবং যশোরে সরকার দলীয় এক এমপির ভাগ্নে পরিচয় দিয়ে ডিপিডিসিতে প্রভাব বিস্তার করেন। দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে চীনা কোম্পানির পক্ষে কাজ করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। চীনের বেসরকারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তেবিয়ান ইলেকট্রিক অ্যাপারাটাস কোম্পানি লিমিটেড (টিবিইএ) এর সঙ্গে মিলিত হয়ে হাদী ও তার সহযোগীরা পছন্দের অযোগ্য ঠিকাদারদের মধ্যে কাজ ভাগাভাগি করে দেন। প্রথমে, একটি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেন পাপ্পু নামের এক ঠিকাদার। এর মাধ্যমে, সাধারণ ও অভিজ্ঞ ঠিকাদাররা বছরের পর বছর ধরে কাজের সুযোগ না পেলেও, অযোগ্য ঠিকাদাররা কাজ পেয়ে যান। পরে, পারভেজ নামে এক ব্যক্তি একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেন এবং তার সঙ্গে যোগ দেন মি. শাও ও মি. লি নামে আরও দুই জন। হাদী এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে প্রকল্পের বেশিরভাগ কাজ অযোগ্য ঠিকাদারদের হাতে তুলে দেন। এতে, ৫/৬টি কোম্পানি একসঙ্গে দরপত্র ফেলে, অথচ তারা সবাই একই সিন্ডিকেটের অংশ।
রাজিবুল হাদীর নামে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একাধিক প্লট, রূপায়নে ফ্ল্যাট এবং যমুনা ফিউচার পার্কে একাধিক দোকানের মালিক। এছাড়া, ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে তার নামে ও বেনামে ফ্ল্যাট রয়েছে। ডিপিডিসির কর্মকর্তা থাকাকালেও তিনি টিবিইএ'র প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন এবং তার নামে ও নিজের বেনামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন—এমা কনস্ট্রাকশন এবং বেসিক। যদিও এই কোম্পানিগুলোর নামে অন্যরা রয়েছে, মূল মালিক হচ্ছেন হাদী এবং ডিপিডিসির মশিউর।
যশোরের গ্রামের বাড়িতে হাদী ও তার স্ত্রীর নামে বিপুল পরিমাণ স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। শাহ নিজাম নামে একজন আওয়ামী লীগ নেতার নাম ব্যবহার করে তিনি বিভিন্নজনকে হুমকি দেয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পরিকল্পনা শাখায় দায়িত্ব পালনকালে ঘুষ, দুর্নীতি, হুমকি ও অসদাচরণের কারণে তাকে ওএসডি করা হয়েছিল। এছাড়া, হাদী তার ব্যক্তিগত স্বার্থে জি টু জি প্রকল্পের সব গোপন নথি চীনা ও দেশীয় ঠিকাদারদের কাছে অর্থের বিনিময়ে পাচার করে দেন। এই বিষয়ে ডিপিডিসির সাবেক এমডি বিকাশ দেওয়ান ও সাবেক প্রকল্প পরিচালক মাহাবুব রহমান তাকে কয়েক দফায় মৌখিকভাবে সতর্ক করেছিলেন।
অভিযোগ রয়েছে, রাজিবুল হাদী চাইনিজ বেসরকারি কোম্পানীগুলোকে বিভিন্ন কাজের নকশা ও ডিজাইন প্রদান করেন, যার মাধ্যমে তিনি প্রকল্পের শত শত কোটি টাকার ক্ষতি করেন। বিশেষ করে, সিনম নামক একটি চাইনিজ কোম্পানিকে ২০০ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ পেতে সহায়তা করেছেন এবং এর বিনিময়ে তিনি ৫% কমিশন গ্রহণ করেছেন বলে অভিযোগ আছে। এই অর্থের বেশিরভাগ অংশ নগদ ডলার ও ইউরোতে পরিশোধ করা হয়েছে।
তিনি অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনেককে চাকরি হারানোর হুমকি দিয়েছেন। কেনাকাটা এবং অন্যান্য দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও প্রতারণা তিনি নিয়মিতভাবে করেন। তার বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অর্থ আমেরিকা এবং দুবাইতে পাচার করার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া, তিনি মতিঝিলে একটি হুন্ডি ব্যবসায়ীর মাধ্যমে এসব অর্থ পাচার করেন।
নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) শফিকুল ইসলাম
আওয়ামী লীগের ১৬ বছর শাসনামলে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) শফিকুল ইসলাম ছিলেন দুর্নীতি ও অনিয়মের অন্যতম কারিগর। তবে, সম্প্রতি তিনি নতুন উদ্যমে দুর্নীতির প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। ৩০ জানুয়ারি, এই বছর তাকে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। ডিপিডিসিতে যোগদানের আগে তিনি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন এবং ঐ প্রকল্প থেকেও শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। প্রকল্প পরিচালক থাকার সময়ে নির্মাণ ব্যয় বারবার বাড়িয়েছিলেন এবং প্রকল্পের ঠিকাদার হিসেবে সাবেক প্রতিমন্ত্রীর আস্থাভাজন ঠিকাদারকে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
শফিকুল ইসলাম এই প্রকল্প থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ নয়ছয় করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল পিডিবিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। ডিপিডিসি সূত্রে জানা গেছে, ২৯ জানুয়ারি নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি ডিপিডিসিতে একটি সিন্ডিকেট গঠন করেন। ডিপিডিসির ডিএসএস, সিএসএস ঠিকাদার নিয়োগ, গ্রাহকদের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়া, বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য নীতিমালা ভঙ্গ করে বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে তিনি জড়িত। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক এবং ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক থাকার সুবাদে তিনি অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। ঢাকায় একাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাট, ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ অর্থ এবং নওগাঁতে একাধিক সম্পত্তি রয়েছে তার। এছাড়া, ঢাকার আফতাব নগরে তার একটি আলিশান ফ্ল্যাটও রয়েছে।
ডিপিডিসির মাফিয়া সাহেদ বিশ্বাস
ডিপিডিসির মিটারিং ডিভিশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ সাহেদ বিশ্বাস। দীর্ঘদিন একই পদে কর্মরত থাকার কারণে এই কর্মকর্তার দুর্নীতির নেটওয়ার্ক ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। শুধুমাত্র স্বেচ্ছাচারিতা নয়, ঘুষ না দিলে গ্রাহকদের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার দেখিয়ে টাকা আদায়, নয়ছয় করে বাড়তি অর্থ গ্রহণ এবং দুর্ব্যবহার তার প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বেশ কয়েকজন গ্রাহকের অভিযোগ, ডিপিডিসির মতো একটি সম্মানজনক প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বে থেকে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন।
সূত্রে জানা গেছে, প্রকৌশলী সাহেদ বিশ্বাসের অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, মিটারিং কোম্পানির কাছ থেকে কমিশন বাণিজ্য এবং সিন্ডিকেটের সদস্যদের সঙ্গে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও তার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। সাহেদ বিশ্বাস পছন্দমতো মিটার কোম্পানির কাছ থেকে গ্রাহকদের মিটার কিনতে বাধ্য করেন। এছাড়া, ডিপিডিসির ৩৬টি ডিভিশনের (কাস্টমার সার্ভিস) প্রকৌশলীরা গ্রাহকদের ওই মিটার কোম্পানির মিটার কিনতে বাধ্য করেন, যার মাধ্যমে সাহেদ বিশ্বাস প্রতি মাসে ১৫ লাখ টাকা কমিশন পেয়ে থাকেন। উচ্চচাপ গ্রাহকদের মিটার কেনা থেকে তিনি প্রতি মাসে ৭/৮ লাখ টাকা কমিশন অর্জন করেন। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সাহেদ বিশ্বাসের পছন্দের কোম্পানি হলো হাইটেক পাওয়ার। তিনি এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোবারক হোসেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে মিটার সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, এই কোম্পানি থেকে তিনি পূর্বাচলে একটি প্লট তার স্ত্রীর নামে নিয়েছেন। এছাড়া, মাঠ পর্যায়ের দুই প্রকৌশলী আনোয়ার ও পলাশ যে টাকা সংগ্রহ করতেন, তার অর্ধেক অংশ সাহেদ বিশ্বাসের পকেটে যেতো বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
হাইটেক পাওয়ার কোম্পানির নিম্নমানের এইচটি মিটার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা, যদিও অন্যান্য কোম্পানির এসটি মিটার মূল্য ১ লাখ ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। একইভাবে, এলটিসিটি মিটার দাম রাখা হয়েছে ৭০ হাজার টাকা, যা অন্য কোম্পানির মিটার মাত্র ৪০ হাজার টাকায় পাওয়া যায়, ফলে গ্রাহককে ২৯ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ করতে হয়। সাহেদ বিশ্বাস এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হাইটেক পাওয়ার কোম্পানির মিটার ছাড়া অন্য কোনো কোম্পানির মিটার ক্রয় করতে বাধা দেন, বিভিন্ন ত্রুটি ধরে তাদের আটকে দেন।
জমির দালালীতে হুজ্জাতের টাকার পাহাড়
ডিপিডিসির অধীনে দুই বছরের মধ্যে যেসব জমি কেনা হয়েছে, সেগুলোর মালিকদের কাছ থেকে ৩৫% কমিশন নিচ্ছেন ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)-এর ব্যবস্থাপক হুজ্জাত উল্লাহ। এর পাশাপাশি, তিনি ব্যক্তিগতভাবে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে জমি ক্রয়-বিক্রয়ের কাজ শুরু করেন এবং একসময় বোরকার হাউজ খুলে তার দালালি ব্যবসা পরিচালনা করেন। পদ্মা সেতু রেল প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে ডিপিডিসির কর্মকর্তা হুজ্জাত উল্লাহ এক চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি অন্যের জমির জাল কাগজপত্র তৈরি করে ভুয়া মালিক দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়েছেন। ভূমি অফিসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় তিনি এই জালিয়াতি ও দুর্নীতির চক্র পরিচালনা করেছেন, যার ফলে তিনি অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এই ধরনের দুর্নীতির মাধ্যমে হুজ্জাত উল্লাহ শুধু নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি করেছেন, বরং প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারের অর্থও তছরুপ করেছেন।
হুজ্জাত উল্লাহর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছে দুদক। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, হুজ্জাত উল্লাহর দাখিল করা সম্পদ বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, তার এবং স্ত্রীর নামে মোট ২ কোটি ২ লাখ ২৫ হাজার ৯৮১ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে ১১ লাখ ৫৭ হাজার ৮৯০ টাকার অস্থাবর সম্পদ বাদ দিলে, তার নামে ১ কোটি ৯০ লাখ ৬৮ হাজার ৯১ টাকার সম্পদ গোপন করা হয়েছে। পরবর্তীতে তার সম্পদ বিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, হুজ্জাত উল্লাহ নিজ নামে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ হিসেবে মোট ১ কোটি ৯৩ লাখ ৯২ হাজার ৭০৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। এই কারণে, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৬(২) ও ২৭(১) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
প্রায় ৪ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং তথ্য গোপনের অভিযোগে দুদক এই মামলা দায়ের করেছে। ৩০ জুন দুদকের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয় (স্মারক নং ০০.০১.০০০০.৫০৫.০৩.০০১.২১.২৩৬৪৮)। হুজ্জাত উল্লাহ বর্তমানে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং তার নামে বিপুল পরিমাণে সম্পদ রয়েছে, যার মধ্যে ঢাকা শহরের বনশ্রী প্রজেক্টে একটি ফ্ল্যাট এবং টাঙ্গাইলের বেতবাড়ি গ্রামে বিভিন্ন সম্পদ অন্তর্ভুক্ত।
হুজ্জাত উল্লাহর স্ত্রীর নামে ২০১১-২০১২ সালে ক্রয় করা ফ্ল্যাট এবং প্লটের মূল্য ২৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা দেখানো হলেও, বাজার মূল্যে এসব সম্পদের মূল্য ৪ কোটি টাকার বেশি। দুদকে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে স্ত্রীর নামে লেকসিটি কনকর্ডে ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার ফ্ল্যাট দেখানো হলেও, বাজার মূল্য এক কোটি টাকার বেশি। এছাড়াও, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার প্লটের মূল্য ১২ লাখ ৪০ হাজার টাকা দেখানো হলেও, বর্তমানে এর বাজার মূল্য তিন কোটি টাকার কাছাকাছি। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের আয়কর নথিতে এই সম্পদের কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।
অন্যদিকে, টাঙ্গাইলে অস্থাবর সম্পদের মূল্য ১১ লাখ ৫৭ হাজার ৮’শ ৯০ টাকা দেখানো হলেও, বাস্তবে তার মূল্য ৫ কোটি টাকার বেশি। দুদকের তদন্তে দেখা যায় যে, হুজ্জাত উল্লাহর আয়কর নথির সাথে গরমিল রয়েছে, এবং তার বেতন, কৃষি ও অন্যান্য আয়ের হিসাবও সঠিক নয়।
হুজ্জাত উল্লাহর জীবনযাপন অত্যন্ত বৈপরীত্যপূর্ণ। গ্রামে তার একটি সাদামাটা টিনের ঘর থাকলেও, ঢাকায় তিনি বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। তার ছেলে বর্তমানে জাপানে বসবাস করছেন এবং সেখানে একটি রাজমহল তৈরি করেছেন। হুজ্জাত উল্লাহ নিজেও বিলাশবহুল গাড়িতে চলাফেরা করেন, যা তার অবৈধ উপার্জন ও দুর্নীতির অভিযোগকে আরো জোরালো করে তোলে।
নিজ নামে বিভিন্ন এলাকায় বিঘা বিঘা জমি ক্রয় করেছেন হুজ্জাত উল্লাহ। এই সব জমির দেখভাল করেন তার ভাগিনা আবুল বাশার। এছাড়া, তার শ্বশুরবাড়ি ধনবাড়ী উপজেলার ভাইঘাটের পালপাড়ায়ও বিপুল পরিমাণ সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে, যেখানে তিনি শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়-স্বজনদের নামে জমি ক্রয় করেছেন। এভাবে তিনি নিজের সম্পদ গোপন রাখার চেষ্টা করেছেন যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে, এই সম্পদের মালিক ডিপিডিসির এই কর্মকর্তা। হুজ্জাত উল্লাহ যা আয় করেন, সেই টাকা তিনি জাপানে পাচার করেন, এবং তার ছেলে তাসিন জাপানে সেই টাকায় আলিশান জীবনযাপন করছেন। একই জায়গায় তার শ্যালকও বসবাস করেন, এবং তারা হুন্ডি মাধ্যমে টাকা পাচার করে জাপানে পাঠান।
