বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
Natun Kagoj
শেকড়ে ফিরে দেখা:

বৈশাখের বাতাসে প্রাণের স্পন্দন, এ উৎসব হোক চিরকালীন

বৈশাখের বাতাসে প্রাণের স্পন্দন, এ উৎসব হোক চিরকালীন
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

বাংলা ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যখন ১৪৩২ আসে, তখন শুধু একটি নতুন বছর নয়—বাংলা সংস্কৃতির এক অনন্য উৎসব, ভালোবাসা, ঐক্য আর উদ্দীপনার এক নতুন ভোর হাজির হয়। বাংলা নববর্ষে বাঙালি জাতি যেন ফিরে পায় তার শেকড়, তার প্রাণের স্পন্দন। বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-কে ঘিরে এবার পুরো দেশ জুড়ে যে উৎসব-আনন্দ, সংহতি আর সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, তা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক ও অনুপ্রেরণাদায়ক।


দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে শহরের কেন্দ্রস্থল পর্যন্ত—প্রতিটি অঞ্চলে বৈশাখী শোভাযাত্রা, লোকজ মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং ঐতিহ্যবাহী খাবারের আয়োজন দেশজ সংস্কৃতিকে জীবন্ত করে তুলেছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বৈশাখী পোশাকে অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সক্রিয়তা প্রমাণ করে—এ উৎসব দল-মত নির্বিশেষে সব বাঙালির এক প্রাণের উৎসব।

নতুন বছর আমাদের শুধু আনন্দ দেয় না, দেয় দায়িত্বও। পুরনো বছরের ক্লান্তি, দুঃখ, অশান্তি ও বিভাজন ভুলে নতুন সম্ভাবনার পথে হাঁটার প্রতিজ্ঞা করার এটাই উপযুক্ত সময়। বাংলা নববর্ষ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—এই দেশ, এই মাটি, এই সংস্কৃতি আমাদের সকলের। বৈষম্য, সহিংসতা, দূর্নীতি আর সংকীর্ণতা ছেড়ে এক বৃহত্তর বাঙালিয়ানা ধারণের আহ্বানই এই উৎসবের অন্তর্নিহিত বার্তা।


আমরা লক্ষ্য করেছি, এবারের পহেলা বৈশাখে দেশের প্রায় প্রতিটি উপজেলা, জেলা শহর এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও স্থানীয় প্রশাসন, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে। রঙিন ব্যানার, পালকি, লাঠি খেলা, লোকজ গান ও মেলাগুলো কেবল বিনোদনের উপকরণ নয়, এগুলো আমাদের হারাতে বসা শেকড়কে আবার নতুন করে ফিরে পাওয়ার প্রয়াস।

তবে কিছু কিছু জায়গায় নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ এবং বাণিজ্যিকীকরণের প্রভাব লক্ষ করা গেছে। এ বিষয়ে আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে—যাতে নববর্ষের প্রাণ-প্রবাহ কৃত্রিমতা আর আড়ম্বরের নিচে চাপা না পড়ে।


চিরায়ত ঐতিহ্য, লোকজ সংস্কৃতি আর প্রাণবন্ত আয়োজনের মধ্য দিয়ে এবারের নববর্ষ বরণ করে নিয়েছে দেশের সর্বস্তরের মানুষ। রাজধানী থেকে মফস্বল, পাহাড় থেকে সমতল, শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম—প্রতিটি অঞ্চলে বৈশাখ এসেছে রঙের ছোঁয়ায়, হাসিমুখে, পান্তা-ইলিশ আর বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার উচ্ছ্বাস নিয়ে। “বাংলার ঐতিহ্য লালন করি, ষোলআনা বাঙালিয়ানা ধারণ করি”—এই স্লোগানে যেমন মিশে আছে সাংস্কৃতিক চেতনা, তেমনি আছে ঐক্য ও সম্প্রীতির বার্তা।

আমরা আনন্দিত যে, এবারের বৈশাখ উদযাপনে সব রাজনৈতিক মত, বয়স ও পেশা নির্বিশেষে মানুষ একত্র হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি নানা আয়োজনে প্রমাণ হয়েছে—এই উৎসব একদিনের নয়, এটি আমাদের জাতিগত আত্মপরিচয়ের অংশ। এই উৎসবে ছিল না কোনো বিভাজন, ছিল না কোনো ভেদাভেদ—ছিল কেবল ভালোবাসা, মমতা আর সম্মিলনের জয়গান।

তবে আমাদের মনে রাখতে হবে—এই আনন্দ কেবল বৈশাখের প্রথম দিনেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। বৈষম্য, সহিংসতা, সংকীর্ণতা আর অমানবিকতা ভুলে প্রতিদিনের জীবনে আমরা যেন বৈশাখের সেই নির্মলতা, উদারতা আর মানবিকতাকে ধারণ করি।

১৪৩২ শুধু একটি বছর নয়, এটি হোক একটি নতুন যাত্রার প্রতীক—যেখানে থাকবে না হতাশা, হানাহানি কিংবা বিভেদ। থাকুক সহনশীলতা, সংস্কৃতির চর্চা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং উন্নয়নের পথচলা।

আসুন, এই নববর্ষে আমরা সবাই মিলে প্রতিজ্ঞা করি—আমাদের মাঝে বৈশাখের এই আনন্দ থাকবে সারাবছর, সারাজীবন। আমাদের হৃদয় হোক বিশুদ্ধ, আমাদের সমাজ হোক বৈষম্যহীন, এবং আমাদের দেশ হোক সম্প্রীতির এক আলোকিত মডেল।

শুভ নববর্ষ ১৪৩২। এ উৎসব হোক চিরকালীন।


গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন