বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
Natun Kagoj
রক্ষকই যেন ভক্ষক, জড়িত রয়েছেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা

খ্যায়াচলং ও পাইন্দুতে ভুয়া অনুমতিতে বন উজাড়ের মহোৎসব

খ্যায়াচলং ও পাইন্দুতে ভুয়া অনুমতিতে বন উজাড়ের মহোৎসব
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

বান্দরবানের খ্যায়াচলং ও পাইন্দু রেঞ্জে বন বিভাগের প্রত্যক্ষ মদদে চলছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড়ের উৎসব। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট রেঞ্জ অফিসারদের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে কাগজে-কলমে ‘ভুতুড়ে’ জোত তৈরি করে ইস্যু করা হচ্ছে পারমিট, যার অনুকূলে প্রতি মাসে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা।

জমি বা গাছ না থাকা সত্ত্বেও এসব ভুয়া জোতের পারমিটে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে সংরক্ষিত বনের মূল্যবান গাছপালা। এই পুরো কার্যক্রমই পরিচালিত হচ্ছে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) ও তার অধীনস্থ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মৌখিক নির্দেশ ও প্রশ্রয়ে। ফলে রক্ষক হিসেবে নিযুক্ত কর্মকর্তারাই আজ পরিণত হয়েছেন ভক্ষকে।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২৫ সালের মার্চ মাসে খ্যায়াচলং রেঞ্জ থেকে ১১ হাজার ঘনফুট করে দুটি ভুয়া জোত ইস্যু করা হয়েছে, মোট ২২ হাজার ঘনফুটের। একইভাবে পাইন্দু রেঞ্জ থেকে ১১ হাজার ঘনফুট করে তিনটি জোত অনুমোদন দেওয়া হয়, যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৩ হাজার ঘনফুট।

এই পাঁচটি জোতের অনুকূলে ঈদ পরবর্তী সময়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে ব্যাপকভাবে কাঠ কাটার তথ্য মিলেছে। যদিও কাগজে এসব জোতে গাছ থাকার কথা বলা হয়েছে, বাস্তবে সেখানে কোনো বনজ সম্পদ নেই।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বন রক্ষার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এই ধরনের দুর্নীতিপূর্ণ কর্মকাণ্ড বন আইন ও পরিবেশ সুরক্ষা নীতির চরম লঙ্ঘন। প্রয়োজনীয় তদন্ত ও জবাবদিহিতা ছাড়া এই ধ্বংসযজ্ঞ থামবে না।


যেসব এলাকায় জোত ইস্যু করা হয়েছে, সেখানে বাস্তবে গাছের কোনো অস্তিত্ব নেই। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, খ্যায়াচলং ও পাইন্দু রেঞ্জের পাঁচটি জোত পারমিট বন বিভাগের বিভাগীয় কার্যালয়ে বসেই ইস্যু করেন দুই রেঞ্জ অফিসার।

জোতের নির্ধারিত এলাকায় কেউ সরেজমিন যাননি—না রেঞ্জ অফিসার, না সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ), এমনকি বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) নিজেও নয়। নিয়ম অনুযায়ী এসিএফ-এর উচিত ছিল অন্তত ৭৫ শতাংশ এলাকা ঘুরে দেখা, কিন্তু সেটিও হয়নি।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, প্রতিটি জোতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ৭৫০ থেকে ৮৫০টি গাছ, অথচ বাস্তবে এসব জায়গায় সেই সংখ্যক গাছ নেই, এমনকি গাছের নির্ধারিত সাইজও নেই।

সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো—৫৫ হাজার ঘনফুট কাঠের অনুমোদনের বিপরীতে ঘুষ আদায় করা হয়েছে প্রায় ২৮ লাখ টাকা (প্রতি ঘনফুটে ৫০ টাকা)। এই অর্থ অফিস সহকারী সুকান্ত সরকারের মাধ্যমে এসিএফ, ডিএফও এবং সিএফ পর্যন্ত ভাগাভাগি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

খ্যায়াচলংয়ের ফরেস্টার জয়ন্ত কুমার, যিনি ২০২০ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন জুনিয়র কর্মকর্তা, তিনি বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়ে বসেই রেঞ্জের দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ ২০০৪ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত অনেক অভিজ্ঞ ফরেস্টারকে রাখা হয়েছে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। সূত্র জানায়, জয়ন্ত এই লোভনীয় রেঞ্জে পোস্টিং পেতে ডিএফও আব্দুর রহমানকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ দেন, যা অফিস সহকারী সুকান্ত সরকারের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়।

জয়ন্ত কুমার বিভাগীয় অফিসে বসেই রেঞ্জের কার্যক্রম পরিচালনা করেন, রেঞ্জ অফিসে নিয়মিত থাকেন না। তার মাসিক বেতন যেখানে ২৫ হাজার টাকা, সেখানে তিনি জেলা সদরে ১৫ হাজার টাকার ভাড়ায় বাসা নিয়ে থাকেন এবং জীবনযাপনের ব্যয় প্রায় লক্ষাধিক টাকা—যা অবৈধ উপার্জনের ইঙ্গিত দেয়।

অপরদিকে, পাইন্দু রেঞ্জ কর্মকর্তা ফরেস্টার মোদাচ্ছেরও একইভাবে বন কার্যালয়ে বসে জোত পারমিট ইস্যু করছেন। তার এই জোতের আড়ালে সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে কাঠ কেটে পাচার করা হচ্ছে। বিজিবি সম্প্রতি দুটি ট্রাকভর্তি চোরাই কাঠ জব্দ করে যা পাইন্দু রেঞ্জ থেকে ইস্যুকৃত জোতের আওতায় কাটা হয়েছে বলে জানা যায়। অথচ এই রেঞ্জ কর্মকর্তা নিজের উদ্যোগে একটিও কাঠ জব্দ করতে পারেননি।

এ বিষয়ে আলাপকালে ফরেস্টার জয়ন্ত কুমার ও ফরেস্টার মোদাচ্ছের জানান, ‘সব কিছুই এসিএফ ও ডিএফও স্যারের নির্দেশে করা হয়েছে।’

স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন, সংরক্ষিত বনাঞ্চল রক্ষার স্বার্থে দুর্নীতিপরায়ণ এই রেঞ্জ কর্মকর্তাদের অবিলম্বে অপসারণ করা জরুরি। পাশাপাশি ইস্যুকৃত ৫৫ হাজার ঘনফুট পারমিট সংশ্লিষ্ট জোতভূমি সরেজমিন তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।


গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

আরও পড়ুন