বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
Natun Kagoj

চীনে পাচার হচ্ছে বাংলাদেশি নারীরা: দালাল চক্রের ভয়ঙ্কর ফাঁদ

চীনে পাচার হচ্ছে বাংলাদেশি নারীরা: দালাল চক্রের ভয়ঙ্কর ফাঁদ
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে চীনে নারী পাচার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। চীনাদের সঙ্গে বিয়ের প্রলোভন, উন্নত জীবনের স্বপ্ন এবং উচ্চ বেতনের চাকরির লোভ দেখিয়ে সংঘবদ্ধ দালাল চক্র বাংলাদেশের তরুণীদের চীনে পাচার করছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই চক্রটি বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বিস্তৃত একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, যাদের হাত ধরে গত সাত-আট বছরে হাজার হাজার নারী পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিয়ের নামে পাচারের ফাঁদ

দালাল চক্রের প্রধান অস্ত্র ‘বিয়ে’। প্রথমে তারা মেয়েদের বলে, চীনা কোম্পানিতে ভালো বেতনের চাকরির সুযোগ রয়েছে — মাসে বেতন এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত। তবে শর্ত হলো, চীনে যেতে হলে একজন চাইনিজ নাগরিককে বিয়ে করতে হবে। বিয়ের মাধ্যমে মিলবে ভিসা, পাসপোর্ট ও বিদেশ গমনের সুযোগ। দরিদ্র পরিবার ও অল্প শিক্ষিত মেয়েরা এই লোভনীয় অফার পেয়ে রাজি হয়ে যায়।

তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার উত্তরাসহ কয়েকটি নির্দিষ্ট অফিসে, যেখানে ‘চাইনিজ পাত্র’দের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। এরপর দ্রুত বিয়ের কার্যক্রম সম্পন্ন করে শুরু হয় পাচারের প্রক্রিয়া।

চীনে পৌঁছানোর পর নরকযন্ত্রণা

চীনে পৌঁছানোর পরই বাস্তব চিত্র একেবারে ভিন্ন হয়ে পড়ে। তরুণীদের নিয়ে যাওয়া হয় চাইনিজ বরদের বাসায়, যেখানে তারা হয় গৃহবন্দি। ফোন কেড়ে নেওয়া হয়, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুরু হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। তরুণীরা জানায়, তাদের ‘সংসার’ করতে বাধ্য করা হয়, কথাবার্তায় অসম্মতি জানালে মারধর, খাদ্য সংকট ও নানা অবমাননার শিকার হতে হয়।

অনেকেই পরে জানতে পারেন, তাদের প্রতিটি মেয়ের জন্য দালাল চক্র চাইনিজ নাগরিকদের কাছ থেকে ৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছে। অর্থাৎ বিয়ে নয়, এটি ছিল একপ্রকার মানব পাচার—আর তার মোড়কে ছিল প্রতারণা।

টার্গেট: পাহাড়ি ও গ্রামীণ দরিদ্র তরুণী

চক্রটির মূল টার্গেট হলো পাহাড়ি এলাকা ও গ্রামীণ দরিদ্র পরিবারের অল্প বয়সী মেয়েরা, যারা শিক্ষা ও প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে। পার্বত্য জেলা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নীলফামারীসহ বিভিন্ন অঞ্চলের দরিদ্র পরিবার এই চক্রের প্রধান লক্ষ্য। অনেকে পরিবার মেয়ে চাকরি পাবে এবং ভালো জীবন পাবে — এই ভেবে রাজিও হয়ে যায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সচেতনতার অভাব এই পাচারের বড় কারণ। চক্রটি এই অসচেতনতা ও দারিদ্র্যকে পুঁজি করেই তাদের ফাঁদ বিস্তার করেছে।

বিয়ের পেছনে আছে সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক চক্র

এই চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বাংলাদেশ ও চীনের বহু ব্যক্তি ও সংগঠন। রাজধানী ঢাকার উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের একটি আটতলা ভবন চীনা নাগরিকদের ভাড়ায় নিয়ে নারী পাচারের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানা গেছে। এখানেই বিয়ে, পাসপোর্ট, ভিসা প্রসেসিং এবং মেয়েদের বিদেশ পাঠানোর যাবতীয় কার্যক্রম চলে। পাচার চক্রের মূল হোতাদের মধ্যে রয়েছেন, শাকিব শেখ, সুমন, রবিউল ও সুফিয়া।

তারা বাংলাদেশের অংশে চীনা নাগরিকদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। এদের বিরুদ্ধে মানব পাচার, মাদক এবং নারী নির্যাতনের একাধিক মামলা রয়েছে। দুঃখজনকভাবে, বহু অভিযোগ ও মামলার পরও প্রশাসনিক তৎপরতা নেই বললেই চলে।

ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় দালাল চক্র

এই চক্রের সদস্যরা ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা বিজ্ঞাপন ও চাকরির অফার দিয়ে মেয়েদের আকৃষ্ট করে। কখনও তারা নিজেদের পরিচয় দেয় বিদেশি কোম্পানির প্রতিনিধি, আবার কখনও “ম্যারেজ মিডিয়া” নামে অফিস খুলে সরাসরি দালালি করে। এসব পেজ বা অ্যাকাউন্ট দেখে অনেক তরুণী ও তাদের পরিবার সহজেই প্রতারণার ফাঁদে পড়ে।

আইনের চোখ ফাঁকি, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা

পাচার হওয়া অনেক মেয়ের পরিবার অভিযোগ করলেও, কার্যত প্রশাসনিক উদ্যোগ নেই। কেউ কেউ মানব পাচারের মামলা করলেও দালালরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। অনেক পরিবার বলছে, মামলা করার পরও পুলিশ তেমন ব্যবস্থা নেয়নি, আবার অনেক সময় উল্টো ভিকটিমকেই হেয় প্রতিপন্ন করা হয়।

চীনে যেসব মেয়েরা পাচার হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকে আজও নিখোঁজ, কেউ কেউ পালিয়ে বাংলাদেশি দূতাবাসে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, আবার অনেকেই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে বলে তথ্য রয়েছে।

মানবাধিকার সংগঠন ও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ভয়াবহ মানব পাচার রোধে এককভাবে কোনো পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন বাংলাদেশ ও চীনের সরকারের যৌথ উদ্যোগ, পাশাপাশি সমাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও আইনের কঠোর প্রয়োগ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ম্যারেজ মিডিয়া ও দালালদের নিবন্ধন ও নজরদারি করা, সীমান্ত ও এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি, পাচারের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে সচেতনতা কর্মসূচি, সোশ্যাল মিডিয়ায় দালালদের অপারেশন চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা, পাচার হওয়া নারীদের উদ্ধারে দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা

নারী পাচার একটি ভয়ঙ্কর আন্তর্জাতিক অপরাধ। চীনের মতো উন্নত দেশে বাংলাদেশের দরিদ্র ও অল্প বয়সী নারীরা পাচার হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত  ‘বিয়ে’ নামক প্রতারণার মোড়কে। দালাল চক্রের এই নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে হলে এখনই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রশাসনের পাশাপাশি সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা তৈরি করাই পারে এই ভয়ঙ্কর পাচার রোধে বড় ভূমিকা রাখতে।


রকি পাটোয়ারী, উত্তরা
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

আরও পড়ুন