মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে


মাদকাসক্তি শুধু ব্যক্তি নয়, পুরো সমাজের জন্য একটি ভয়াবহ অভিশাপ। বাংলাদেশে বিশেষ করে যুবসমাজের একটি অংশ নেশার জগতে জড়িয়ে পড়ছে, যা আমাদের ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলেছে। মাদকের সহজলভ্যতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের দুর্নীতি, এবং সামাজিক সচেতনতার অভাব—সব মিলিয়ে এই সমস্যা এখন এক জটিল রূপ ধারণ করেছে।
প্রতিদিন খবরের শিরোনামে উঠে আসে ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিলসহ নানা ধরনের মাদক পাচারের খবর। শুধু শহরেই নয়, মাদক এখন গ্রাম-গঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে বেকারত্ব, হতাশা বা কৌতূহলবশত মাদকে জড়াচ্ছেন, আবার কেউ কেউ তা ব্যবসার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের পথ হিসেবে নিচ্ছেন।
এই অদৃশ্য ব্যাধি নিঃশব্দে ধ্বংস করছে আমাদের তরুণ সমাজকে। পরিবারগুলোকে ভেঙে দিচ্ছে। সমাজে সৃষ্টি করছে অপরাধের নতুন মাত্রা। শুধু একটি প্রজন্ম নয়, পুরো জাতি আজ মাদকের ভয়াল ছোবলে বিপন্ন। এই সংকট মোকাবেলায় এখনই সময় কঠোর অবস্থান নেওয়ার, সময়ক্ষেপণ ভবিষ্যৎকে আরও অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেবে।
একসময় সীমান্তবর্তী কিছু এলাকায় সীমিত আকারে মাদক প্রবেশ করত কিন্তু বর্তমানে দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল, আইসসহ নানা ধরনের মাদকদ্রব্য সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মাঝেও মাদকের ছায়া পড়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সমাজে দিন দিন বাড়ছে চুরি, ছিনতাই, হত্যাসহ নানা ধরনের অপরাধ, যার পেছনে মাদকের প্রভাব স্পষ্ট।
তবে মাদকের বিস্তার শুধু ভোক্তাদের কারণে নয়। এর পেছনে রয়েছে একটি সুসংগঠিত চক্র, যার সঙ্গে জড়িত রয়েছে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। অনেক সময়ই দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্য কিংবা প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও এই চক্রের ছত্রছায়ায় কাজ করছে। এতে শুধু আইনি প্রয়াস নয়, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক নিষ্ঠাও এই যুদ্ধে একান্ত জরুরি।
সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে মাদক চোরাচালান রোধে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কাস্টমস বিভাগের তৎপরতা অনেকাংশে প্রশংসনীয় হলেও তা যথেষ্ট নয়। চোরাকারবারিরা এখন নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করছে, প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, এমনকি নারী ও শিশুদেরও ব্যবহার করছে। তাই গোয়েন্দা নজরদারি, প্রযুক্তি নির্ভরতা ও আন্তঃবাহিনী সমন্বয় আরও জোরদার করতে হবে।
শুধু আইন প্রয়োগ করেই মাদক নির্মূল সম্ভব নয়, বরং সমন্বিত সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজন। পরিবারই হচ্ছে সন্তানের প্রথম পাঠশালা। তাই মা-বাবাদের সচেতন হতে হবে সন্তানের আচরণ, চলাফেরা ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি মাদকবিরোধী সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমাজে মূল্যবোধ জাগাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও মাদকবিরোধী বার্তা পৌঁছাতে হবে সর্বস্তরে। জনপ্রিয় সংস্কৃতি, নাটক, গান, সিনেমা—সবখানেই মাদকের বিরুদ্ধে সরব অবস্থান নিতে হবে। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটিয়ে যুবসমাজকে ব্যস্ত রাখতে হবে গঠনমূলক কাজে।
সরকারের তরফ থেকেও প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার। এই যুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা জরুরি। দেশের প্রতিটি থানায় মাদক নিয়ন্ত্রণে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন, মাদক পুনর্বাসন সেন্টার সম্প্রসারণ, এবং মাদকবিরোধী আইনের কঠোর প্রয়োগ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে যাতে কোনো অপরাধী, যত প্রভাবশালীই হোক না কেন, আইনের ঊর্ধ্বে না থাকতে পারে।
আমরা এমন একটি সমাজ চাই, যেখানে তরুণরা স্বপ্ন দেখে, সম্ভাবনার পথে হাঁটে—নেশার অন্ধকারে ডুবে না যায়। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আমাদের এখনই মাদকের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করতে হবে। না হলে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে দায়মুক্ত থাকতে পারব না।
