বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
Natun Kagoj

তিন দফা দাবি নিয়ে ভোলাবাসীর আন্দোলন: উন্নয়নের পথে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ

তিন দফা দাবি নিয়ে ভোলাবাসীর আন্দোলন: উন্নয়নের পথে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

ভোলা, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি দ্বীপ জেলা। যার ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনসংখ্যার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলেও দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত। ১৯ লক্ষ মানুষের এই অঞ্চলের জনগণ উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করে আসছে। সম্প্রতি ভোলার জনগণ তিনটি মৌলিক দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছে। ভোলা-বরিশাল সেতু নির্মাণ, ভোলায় মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগ প্রদান। এই আন্দোলন শুধুমাত্র ভোলার জনগণের নয়, বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের প্রতিফলন।

ভোলা-বরিশাল সেতু: যোগাযোগের উন্নতি ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

ভোলা জেলা বাংলাদেশের একমাত্র দ্বীপ জেলা। যা তিনদিক থেকে নদী ও সাগর দ্বারা বেষ্টিত। এই কারণে ভোলার জনগণ দেশের মূল ভূখণ্ডের সাথে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের অভাবে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। বিশেষ করে জরুরি চিকিৎসা সেবা, ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও শিক্ষার জন্য বরিশাল বা ঢাকায় যেতে হলে নদীপথে নির্ভর করতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ ও ঝুঁকিপূর্ণ।

২০১৯ সালে বাংলাদেশ সরকার পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ভিত্তিতে তেঁতুলিয়া ও কালাবাদো নদীর উপর দিয়ে ভোলা-বরিশাল সেতু নির্মাণের অনুমোদন দেয়। এই সেতুর দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ১০ কিলোমিটার এবং নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকা। পদ্মা সেতুর তুলনায় এটি ব্যয়ের দিক থেকে কম হলেও, ভোলার জনগণের জন্য এটি একটি স্বপ্নের মতো। ভোলার গ্যাস সম্পদ, কৃষি উৎপাদন ও মৎস্য খাতের উন্নতির জন্য এই সেতু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ভোলা-বরিশাল সেতু নির্মাণ হলে:

১. যোগাযোগ সহজ হবে: ভোলা ও বরিশালের মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে, যা সময় ও অর্থ সাশ্রয় করবে।

২. অর্থনৈতিক উন্নতি: ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ও মৎস্য খাতের উন্নতি হবে, যা ভোলার অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে।

৩. শিক্ষার প্রসার: শিক্ষার্থীরা সহজে বরিশাল ও ঢাকায় যেতে পারবে, যা তাদের শিক্ষার মান উন্নত করবে।

৪. স্বাস্থ্য সেবা: উন্নত চিকিৎসা সেবা গ্রহণের জন্য বরিশাল ও ঢাকায় যাতায়াত সহজ হবে।

এই সেতুর অভাবে ভোলার জনগণ যে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে, তা কল্পনাতীত। তাই, ভোলা-বরিশাল সেতু নির্মাণের দাবি শুধু একটি অবকাঠামোগত উন্নতির বিষয় নয়, এটি ভোলার জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন।

ভোলায় মেডিকেল কলেজ: স্বাস্থ্য সেবায় অগ্রগতি

ভোলা জেলার ১৯ লক্ষ মানুষের জন্য একটি আধুনিক ও মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে, ভোলায় ২৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল রয়েছে, তবে সেখানে ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্টাফের অভাব রয়েছে। চিকিৎসা সরঞ্জাম ও অবকাঠামোর মানও অত্যন্ত নিম্নমানের। এর ফলে, ভোলার জনগণ উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল বা ঢাকায় যেতে বাধ্য হয়, যা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল।

ভোলায় একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা হলে:

১. মানসম্মত চিকিৎসা সেবা: স্থানীয় জনগণ উন্নত চিকিৎসা সেবা পাবে, যা তাদের জীবনমান উন্নত করবে।

২. চিকিৎসক তৈরির সুযোগ: মেডিকেল কলেজের মাধ্যমে দক্ষ চিকিৎসক তৈরি হবে, যারা ভবিষ্যতে ভোলার স্বাস্থ্য সেবা খাতে অবদান রাখবে।

৩. অর্থনৈতিক উন্নতি: মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা স্থানীয় অর্থনীতিতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে।

ভোলার জনগণ দীর্ঘদিন ধরে এই দাবি জানিয়ে আসছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই দাবির পক্ষে আন্দোলন করছে। তাদের মতে, ভোলায় মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা একটি মৌলিক অধিকার, যা ভোলার জনগণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ভোলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: জ্ঞানভিত্তিক সমাজের পথে পদক্ষেপ

বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার উন্নয়নে শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, আর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি সেই উন্নয়নের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে। ভোলা জেলার ১৯ লক্ষ মানুষের মধ্যে তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অত্যন্ত বেশি। কিন্তু এই বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীর উচ্চশিক্ষার জন্য নিজ জেলায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। ফলে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে ঢাকা, চট্টগ্রাম বা বরিশালের মতো শহরে পাড়ি জমাতে হয়। এতে শুধু অর্থনৈতিক চাপ বাড়ে না, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়।

বর্তমানে ভোলায় কয়েকটি কলেজ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় না থাকার কারণে গবেষণা, উদ্ভাবন ও আধুনিক জ্ঞানচর্চার সুযোগ নেই। অথচ একটি বিশ্ববিদ্যালয় হলে:

১. উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হবে স্থানীয় পর্যায়ে, যা শিক্ষার্থীদের সময়, অর্থ ও ঝুঁকি কমাবে।

২. গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কাজ হবে স্থানভিত্তিক সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে, যা স্থানীয় সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

৩. স্থানীয় অর্থনীতিতে গতি আসবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের কারণে, যেমন: আবাসন, পরিবহন, খাদ্য, প্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থান বাড়বে।

৪. নারীদের জন্য উচ্চশিক্ষা আরও সহজলভ্য হবে, যা নারীশিক্ষা বিস্তারে বড় অবদান রাখবে।

ভোলার জনগণ এখন একবাক্যে বলছে, আমরা উন্নয়ন, আধুনিকতা ও মর্যাদার প্রতীক একটি পূর্ণাঙ্গ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চাই। এটি এখন কেবল দাবি নয়, এটি একটি আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। সামাজিক সংগঠন, ছাত্র ইউনিয়ন, শিক্ষক, পেশাজীবী ও সাধারণ জনগণের এই দাবি এখন গণচেতনায় রূপ নিয়েছে।

বাংলাদেশের অনেক ছোট জেলা যেমন: কিশোরগঞ্জ, মেহেরপুর কিংবা নেত্রকোনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করা হয়েছে বা হচ্ছে, অথচ ভোলার মতো জনবহুল ও সম্ভাবনাময় জেলায় এখনো কোনো পদক্ষেপ নেই। এটি শুধু অবহেলা নয়, এটি অসমতার বহিঃপ্রকাশ।

ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগ: মৌলিক সেবা ও জীবনমান উন্নতি

ভোলা জেলা প্রাকৃতিক গ্যাসের একটি সমৃদ্ধ ভান্ডার হিসেবে পরিচিত। এখানে ৯টি গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে, যার মোট মজুদ প্রায় ১.৭৫ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট (TCF)। এই গ্যাস দেশের জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হলেও ভোলার জনগণ ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগ থেকে বঞ্চিত। ২০১০ সালে ভোলা পৌর এলাকায় ৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন বসিয়ে ২৫০০ পরিবারকে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছিল, তবে পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে এই কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

ভোলায় ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগ প্রদান হলে:

১. জীবনমান উন্নতি: রান্নার জন্য গ্যাস ব্যবহারে মানুষের জীবনমান উন্নত হবে।

২. অর্থনৈতিক সুবিধা: গ্যাসের সহজলভ্যতা স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যকে সমৃদ্ধ করবে।

৩. পরিবেশবান্ধব: কাঠ বা অন্যান্য জ্বালানি ব্যবহারের পরিবর্তে গ্যাস ব্যবহারে পরিবেশ দূষণ কমবে।

ভোলার জনগণ তাদের এই মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করে আসছে। তাদের মতে, গ্যাস সংযোগ একটি মৌলিক সেবা, যা তাদের জীবনমান উন্নত করতে সহায়ক হবে।

আন্দোলনের গুরুত্ব ও সরকারের প্রতি আহ্বান

ভোলার জনগণের এই তিনটি দাবি শুধুমাত্র অবকাঠামোগত উন্নতির বিষয় নয়, এটি তাদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন। ভোলা-বরিশাল সেতু, মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগ প্রদান ভোলার জনগণের জীবনমান উন্নত করবে এবং তাদের উন্নয়নের পথে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।

সরকার ও নীতিনির্ধারকদের প্রতি অনুরোধ:

১. ভোলা-বরিশাল সেতু নির্মাণে অবিলম্বে প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করুন।

২. ভোলায় পূর্ণাঙ্গ সরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করুন, এবং জেলা হাসপাতালকে এটাচড হাসপাতালে উন্নীত করুন।

৩. ভোলায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করুন, যেখানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কৃষি, মেরিন ও গ্যাসভিত্তিক গবেষণার সুযোগ থাকবে।

৪. ভোলার ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগ নিশ্চিত করুন—যেখানে গ্যাস উৎপন্ন হয়, সেখানে ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে।

৫. অঞ্চলভিত্তিক সমতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।

উপসংহার: একটি সম্ভাবনাময় ভোলার পথে

ভোলা শুধুমাত্র নদী-বেষ্টিত এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দ্বীপ নয়, এটি বিশাল সম্ভাবনার কেন্দ্র। গ্যাস, কৃষি, মৎস্য ও জনশক্তির দিক দিয়ে এটি বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারে। কিন্তু এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে ভোলার মানুষের মৌলিক চাহিদা ও দাবিকে সম্মান জানাতে হবে। উন্নয়ন যেন কারো জন্য বিশেষ সুবিধা না হয়ে বরং সবার জন্য ন্যায্য অধিকার হয়—এই আন্দোলন সেই বার্তাই দিয়েছে।

ভোলার মানুষ আজ বলছে, “আমরাও মানুষ, আমাদেরও অধিকার আছে। ভোলার জন্য ভোলা নয়, বরং একটি সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে, আমাদের দাবি এখনই পূরণ করতে হবে।


গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন