বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
Natun Kagoj
ফায়ার সার্ভিসে বিতর্ক ও অসন্তোষ:

নীতিমালা ভেঙে স্বৈরাচারের দোসর ওহিদুল ইসলামকে ডিডি এডমিন করে পদায়ন

নীতিমালা ভেঙে স্বৈরাচারের দোসর ওহিদুল ইসলামকে ডিডি এডমিন করে পদায়ন
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরে বদলি ও পদায়নে নীতিমালা উপেক্ষার অভিযোগ উঠেছে। সর্বশেষ ১৭ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ এক আদেশে মো. ওহিদুল ইসলামকে অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) হিসেবে পুনরায় পদায়ন করেছে, যা সংশ্লিষ্ট নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

২০২৩ সালের বদলি ও পদায়ন নীতিমালার ৫.১ ধারা অনুযায়ী, একই কর্মস্থলে কোনো কর্মকর্তা তিন বছরের কম সময় দায়িত্বে থাকলে তাকে একই পদে পুনরায় নিয়োগ দেওয়া যায় না। অথচ মাত্র সাড়ে ৫ মাস আগে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক ওহিদুল ইসলামকে উপ-পরিচালক পদ থেকে সরিয়ে মিরপুর ট্রেনিং কমপ্লেক্সে অধ্যক্ষ হিসেবে বদলি করা হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে আবারও তাকে বদলী করে অধিদপ্তরে উপ-পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) করা হয়েছে।

এছাড়া, নীতিমালার ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নবম গ্রেড ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের বদলির ক্ষেত্রে অধিদপ্তরের সুপারিশ প্রয়োজন হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ওহিদুল ইসলামের পদায়নের ক্ষেত্রে অধিদপ্তরের কোনো প্রস্তাব ছিল না। তা সত্ত্বেও মন্ত্রণালয় ‘ভুতুড়ে আদেশ’ জারি করে তাকে অধিদপ্তরে ফিরিয়ে এনেছেন।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেন, “ওহিদুল ইসলামের বদলির আদেশ মন্ত্রণালয় দিয়েছে। আমি এ বিষয়ে বেশি কিছু বলতে পারবো না।”

অপরদিকে, প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষরকারী উপসচিব সফিকুল ইসলাম বলেন, “এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না, সিনিয়ররাই ভালো জানেন।”

সূত্র জানায়, ওহিদুল ইসলাম আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অত্যন্ত প্রভাবশালী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ওহিদুল নিয়োগ, কেনাকাটা, টেন্ডারসহ প্রশাসনিক বিভিন্ন বিষয়ে কর্তৃত্ব ফলাতেন। তার বিরুদ্ধে অতীতে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি এবং দলীয় পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও রয়েছে।

২০২২ সালের ১৩ মে ফায়ার সার্ভিসের শারীরিক যোগ্যতা যাচাই পরীক্ষা হঠাৎ স্থগিত করার ঘটনায় তিনি বিতর্কের মুখে পড়েন। তখন তাকে রাজশাহীতে বদলি করা হয়, তবে কিছুদিন পরই আবার উপ-পরিচালক পদে ফিরিয়ে আনা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, “ড. ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পরেও ফায়ার সার্ভিসে পূর্বের সিন্ডিকেট সক্রিয়। ওহিদুল ইসলাম সেই সিন্ডিকেটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, যারা নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও কেনাকাটায় কোটি কোটি টাকার লেনদেন করেছে।”

ওহিদুল ইসলামের পুনর্বহালকে ঘিরে অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ বিরাজ করছে। কারণ, অতীতে তার কর্মকাণ্ডে বহু কর্মী হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং একাধিক সাবেক সচিবের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ওহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে রয়েছে ব্যাপক লবিং ও ঠিকাদার নিয়ন্ত্রিত দুর্নীতির অভিযোগ। তার ভাই শাহীন আওয়ামী লীগ নেতা। ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক উত্তপ্ত পরিবেশে তিনি এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান।

সূত্র জানায়, ওহিদুলের পছন্দের এক ঠিকাদার তার পেছনে বিনিয়োগ করে তাকে ঢাকায় আনার প্রচেষ্টা চালান। শ্যামলীতে অবস্থিত সেই ঠিকাদারের অফিস থেকে পরিচালিত হয় সবকিছু। জানা যায়, ঠিকাদারটি নিজেকে কখনও ‘ছায়া ডিজি’, কখনও দলবদলকারী নেতাকর্মী হিসেবে পরিচয় দেন।

এই সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ, বদলি, টেন্ডার ও অন্যান্য প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। ফলে অন্যান্য ঠিকাদাররা বঞ্চিত হয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছেন।

ওহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে অতীতে সহকারী পরিচালক, ওয়ারহাউজ এবং ফায়ার প্রিভেনশন পদে দায়িত্ব পালনের সময় কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তিনি ও তার পরিবারের নামে বগুড়া, রাজশাহী, ঢাকা, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন স্থানে জমি, প্লট, গাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

উত্তরায় একটি ২০ কাঠা জমিতে তিনি গড়ে তুলেছেন একটি ডেইরি ফার্ম, যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা। এছাড়া, তিনি ও তার ঠিকাদার অংশীদার ব্যবসার মাধ্যমে আরও বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন।

গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে পূর্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওহিদুল ইসলামকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে রাজশাহীতে বদলি করে। কিন্তু সেখানে থাকতে অনিচ্ছুক ওহিদুল ইসলাম ঢাকায় ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে ট্রেনিং কমপ্লেক্স, মিরপুরের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করলেও পুনরায় উপপরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) পদে ফিরে আসেন, যা নীতিমালার পরিপন্থী।

অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ওহিদুল ইসলাম দায়িত্বে থাকাকালে প্রশাসনিক নির্যাতন, তুচ্ছ কারণে বদলি এবং বেপরোয়া দুর্নীতির কারণে কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ তীব্র ছিল।

তার রাজনৈতিক পক্ষপাত ও সরকারের সুবিধাভোগী হিসেবে অতীত ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, অজ্ঞাত কারণে তিনি বারবার গুরুত্বপূর্ণ পদে ফিরে আসছেন।

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে মো. ওহিদুল ইসলাম বলেন, “আমার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সঠিক নয়। বদলি বা পদায়নে আমি কোনো তদবির করিনি। যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে, সেটা মন্ত্রণালয় করেছে।”


গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

আরও পড়ুন