হজে গিয়ে পালানোর পরিকল্পনায় ভোলার আলোচিত নেতা শামীম মোরাদার


ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন ওরফে শামীম মোরাদার হজ পালনের আড়ালে বিদেশে পালানোর পরিকল্পনা এখন টক অব দ্য টাউন। সূত্র বলছে, চলতি মে মাসেই তিনি সৌদি আরবে হজ পালনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন এবং সেখান থেকেই অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দিয়ে আত্মগোপনে চলে যাবেন।
তবে তার এ সফরকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে জোর আলোচনা। কারণ, তার বিরুদ্ধে একের পর এক গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। টেন্ডারবাজি, অবৈধ বালু উত্তোলন, চাঁদাবাজি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং এমনকি বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তার করার মতো স্পর্শকাতর অভিযোগও সামনে এসেছে।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, শামীম মোরাদার ভোলায় আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ‘রাজত্ব’ কায়েম করেছিলেন। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন সরকারের বিগত মেয়াদে তিনি প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় এলাকায় টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, সরকারি প্রকল্পে দখলদারি, এবং নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হন।
ভোলা সদরের এক ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “সরকারি প্রকল্পের কোনো টেন্ডার শামীম মোরাদারের অনুমতি ছাড়া পাওয়া যেত না। উনি না চাইলে কাগজ জমাও করা যেত না।”
ভোলার মেঘনা নদীতে বছরজুড়েই চলে বালু উত্তোলন। তবে অভিযোগ রয়েছে, শামীম মোরাদার নিজস্ব চক্রের মাধ্যমে নিয়মবহির্ভূতভাবে স্বৈরাচার হাসিনার শাসনামলে সরকারি বিধি অমান্য করে কোটি কোটি টাকার বালু উত্তোলন করেছেন। এতে নদীর গতিপথ পরিবর্তন, ভাঙন এবং কৃষিজমির ব্যাপক ক্ষতির ঘটনা ঘটে।
পরিবেশ আন্দোলনের এক সদস্য জানান, “শুধু পরিবেশ নয়, জীবিকা হারিয়েছে অনেক জেলে পরিবার। অথচ কেউ তাদের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পেতো না।”
বিচার বিভাগেও প্রভাব: সাবেক জেলা ও দায়রা জজের ঘনিষ্ঠতা
সবচেয়ে আলোচিত অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে, সাবেক ভোলা জেলা ও দায়রা জজ এ.বি.এম মাহমুদুল হকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে শামীম মোরাদার আদালতের বিভিন্ন টেন্ডার ও কার্যক্রম নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন।
সূত্র দাবি করে, এই ঘনিষ্ঠতা রাজনৈতিক নয়, বরং সুবিধাভোগী আদান-প্রদান ও সুবিধা দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, তিনি বিচারককে প্রভাবিত করতে ‘নারী সাপ্লাই’ পর্যন্ত করেছেন, যদিও এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।
স্বৈরাচার শাসনকালে দাপট, পরে ঢাকা পালিয়ে পলাতক জীবন
৪ আগস্টের আগে ভোলায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় শামীম মোরাদারের নাম উঠে আসে। এ ঘটনার পর তিনি ঢাকায় আত্মগোপনে চলে যান এবং বর্তমানে রাজধানীতেই অবস্থান করছেন।
ঢাকার একটি অভিজাত এলাকায় অবস্থানরত এক বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, “উনি সবসময়ই ফোন বন্ধ রাখেন, হঠাৎ হঠাৎ দেখা মেলে। হজে যাওয়ার জন্য ভিসা আগেই পেয়েছেন।”
মামলা থেকে মুক্তি টাকার বিনিময়ে!
ভোলায় ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে কয়েকটি মামলা হয়। ছাত্র-জনতার ওপর হামলার পেছনে শামীম মোরাদারের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান। তবে এসব মামলায় তার নাম উঠে এলেও, একটিতেও শামীম মোরাদারের নাম নেই।
অভিযোগ রয়েছে, তিনি বিরোধী দলের একটি অংশকে অর্থের বিনিময়ে চুপ করিয়ে দেন এবং মামলায় নাম যেনো না দেওয়া হয় তার জন্য অর্থ ব্যয় করেন।
ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের এক যুগ্ম সম্পাদক দীর্ঘদিন ধরে শামীম মোরাদারের ছায়া হয়ে কাজ করে গেছেন বলে দাবি উঠেছে। এই সহযোগিতার ফলে দলীয় বা প্রশাসনিক পর্যায়ে কোনো জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হয়নি তাকে।
এক স্থানীয় সাংবাদিক বলেন, “ভোলায় উনি ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। দলীয় নেতার ছায়ায় প্রশাসনের কেউই তাকে প্রশ্ন করার সাহস করেনি।”
হজ সফরের আড়ালে পলায়ন পরিকল্পনা
সবশেষ পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, শামীম মোরাদার চলতি মে মাসেই হজ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব যাবেন। অথচ স্থানীয় প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
গোয়েন্দা সূত্র থেকে জানা যায়, হজ শেষে তিনি সৌদি আরব থেকে সরাসরি অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দিতে চান। তার জন্য ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বুকিংও সম্পন্ন হয়েছে বলে এক ট্রাভেল এজেন্সির সূত্র নিশ্চিত করেছে।
জনমনে প্রশ্ন: দায়মুক্তির সংস্কৃতি?
শামীম মোরাদারের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ, অথচ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন সচেতন নাগরিকরা। তাদের মতে, রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি হজের আড়ালে বিদেশে পালিয়ে যেতে পারেন, তবে তা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করে।
ভোলার আলোচিত নেতা শামীম মোরাদারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের অভিযোগ ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ড তাকে ‘অপরাধী সুবিধাভোগী’ হিসেবে চিহ্নিত করছে। হজ সফরের সুযোগ নিয়ে বিদেশে পালানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে সেটি শুধু আইনের ব্যর্থতা নয়, দেশের রাজনৈতিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের একটি বড় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে—এবার কি রাষ্ট্র ব্যবস্থা শামীম মোরাদারের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরও জবাবদিহির আওতায় আনবে?
