শাহবাগে জনতার প্রত্যাশা—প্রতিবাদের ভাষা হোক সমাধানের সেতুবন্ধন


ঢাকার শাহবাগ যেন আবারো ফিরে গেছে তার চেনা পরিচয়ে—আন্দোলনের শহর। গত কয়েকদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে নানা দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে এই জনপদ। কখনো শিক্ষার্থীদের পদযাত্রা, কখনো স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত নার্সিং শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, আবার কখনো রাজনৈতিক দাবিতে রাজপথে উপস্থিতি—সব মিলিয়ে শাহবাগ এখন আর শুধু একটি জায়গা নয়, এটি হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের প্রতীক।
আজ সকালেই ‘লং মার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচি পালন করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের তিন দফা দাবি নিয়ে রাস্তায় নামা, গণতান্ত্রিক চর্চার একটি স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা। আন্দোলন চলাকালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপ ও টিয়ারসেল-সাউন্ডগ্রেনেড ব্যবহারের ঘটনা ঘটে, যা পরিস্থিতিকে আরও সংবেদনশীল করে তোলে। তবে এটি কেবল নিরাপত্তার দিক বিবেচনায় নেওয়া পদক্ষেপ হিসেবে দেখা উচিত—এই বাস্তবতাও উপলব্ধি করা জরুরি।
বেলা গড়াতেই শাহবাগে অবস্থান নেন নার্সিং শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলন নতুন নয়—পেশাগত মর্যাদা, চাকরির স্থায়ীকরণ ও ন্যায্য বেতনের দাবিতে তারা বহুবার রাজপথে নেমেছেন। একটি দেশের স্বাস্থ্যখাতের কাণ্ডারি হিসেবে নার্সদের প্রতি রাষ্ট্রের দায় যেমন নৈতিক, তেমনি কাঠামোগতও। কিন্তু বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া কেবল হতাশাজনকই নয়, ভয়াবহও। স্বাস্থ্যখাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এই শিক্ষার্থীরা যে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ চিকিৎসা ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, তা নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। তাই তাদের কণ্ঠস্বর শোনা এবং প্রয়োজনীয় নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ সময়ের দাবি।
এর কিছুদিন আগে একই শাহবাগ এবং প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ‘যমুনা’ ঘিরে অনুষ্ঠিত হয় আরেকটি রাজনৈতিক কর্মসূচি। আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে হাসনাত আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল রাজপথে অবস্থান নেয়। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে—আওয়ামী লীগের রাজনীতি জুলাই-আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের সময়কার হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ থাকবে। এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত, যার প্রভাব রাজনীতির মূলস্রোতে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে মনে করিয়ে দিতে হয়—এই আন্দোলনের মূল শিকড় নিহিত রয়েছে গত জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনে। সেসময়ের আহতরা এখনো তাদের বিচারের দাবিতে শাহবাগে অবস্থান করছেন। অন্যায়ের বিচার না হলে তা শুধু ইতিহাসে একটি কালো দাগ হয় না, তা ভবিষ্যতের প্রতিবাদের বীজও বয়ে আনে।
সবকিছু মিলিয়ে স্পষ্ট হচ্ছে, শাহবাগের আন্দোলনসমূহ বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এগুলো দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, অবহেলা ও অবিচারের প্রতিফলন।
আজ শাহবাগের রাজপথ শুধু একটি জায়গা নয়—এটি হয়ে উঠেছে প্রত্যাশা, হতাশা, এবং সম্ভাবনার সমান্তরাল মঞ্চ। এখানে কণ্ঠস্বর উঠে আসছে ন্যায়বিচারের জন্য, মর্যাদার জন্য, ভবিষ্যতের জন্য।
আমরা বিশ্বাস করি, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। আর রাষ্ট্রের দায়িত্ব সেই সৌন্দর্য রক্ষা করা, সংবেদনশীলতা ও সহানুভূতির সঙ্গে। সাহসী দাবি ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলতার মিলনস্থল যদি হয় শাহবাগ, তবে ভবিষ্যতের ইতিহাস লিখবে আশার গল্প।
